এই বাড়িটায় কিছু আছে কি না কে জানে। কিছু কিছু বাড়ি থাকে দেশ লাগা। জীবন্ত প্রাণীর মত স্বভাব থাকে সেসব বাড়ির। জীবন্ত প্রাণী যেমন মানুষকে আগ্রহ। নিয়ে দেখে–দোষ লাগা বাড়িগুলিও তাই করে। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। এই যে পারুল চুপি চুপি পাশের ঘরে যাচ্ছে–বাড়িটা সে ব্যাপারটা দেখছে। আগ্রহ নিয়েই দেছে। পারুলের ভয় ভয় করছে–ইচ্ছা করছে আবার তাহেরের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়তে। এই বাড়িতে বেশিদিন থাকা ঠিক হবে না। বেশিদিন থাকলে ভয়েই পারুলের কোন অসুখ-বিসুখ হয়ে যাবে। শরীরের এই অবস্থায় অসুখ-বিসুখ হওয়া ভাল না। পারুলের এখন দুমাস চলছে। এই সময়টাই সবচে খারাপ সময়। বেশিরভাগ এবোরশন এই সময়ে হয়।
তাদের অবশ্যি বেশিদিন থাকতে হবে না। আগামী মঙ্গলবার পর্যন্ত থাকবে। মঙ্গলবার আসতে আর মাত্র চারদিন।
অন্ধকারে সুইচ বোর্ড খুঁজে পাওয়া যায় না। দিক এলোমেলো হয়ে যায়। পুবকে মনে হয় পশ্চিম। পশ্চিমকে মনে হয় দক্ষিণ। পারুলের ভাগ্য ভাল, প্রথমবারেই সে সুইচ খুঁজে পেল। বাতি জ্বালাল। তার সামনেই আমন। পানি দেখলে যেমন ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করে, আয়না দেখলেই তেমন তাকাতে ইচ্ছা করে। আয়নার ভেতর। নিজেকে দেখতে ইচ্ছা করে। পারুল কিন্তু তাকাল না। চোখ ঘুরিয়ে নিল এ্যাডফাদার ক্লকে। কি সুন্দর তালে তালে শব্দ হচ্ছে—টক-টকাস, টক-টকাস। তার প্রচণ্ড ইচ্ছা করছে মাথা ঘুরিয়ে আয়নাটার দিকে তাকাতে। এত জোরালো ইচ্ছাকে অগ্রাহ্য করতে হলে এই ঘরে থাকা যাবে না। পারুল বসার ঘরের দিকে রওনা হল।
বসার ঘরের সুইচ বোর্ডে অনেকগুলি সুইচ। তার ইচ্ছা করছে ঝাড়বাতির সুইচটা জ্বালাতে। এই বাড়ির ঝাড়বাতি কি যে সুন্দর! মনে হয় দশ হাজার মোমবাতি এক সঙ্গে জ্বলে ওঠে। শুধু জ্বলেই শেষ না–জোনাকি পোকার মত মিটমিট করতে থাকে। এরকম একটা ঝাড়বাতির দাম কত হবে? তাহের সারা জীবন কত টাকা রোজগার করবে তা দিয়ে কি একটা ঝাড়বাতি কেনা যাবে? মনে হয় না। তবে মানুষের ভাগ্য তো। কিছুই বলা যায় না। পথের ফকিরও কোটিপতি হয়। তাদের জীবনেও এমন কিছু ঘটতে পারে। যদি ঘটে তাহলে পারুল ঠিক করে রেখেছে সে প্রথম যে জিনিসটা করবে তা হচ্ছে–ঝাড়বাতি কেনা। ঠিক এরকম একটা ঝাড়বাতি। ঝাড়বাতিটা সে শুধু জ্বালাবে বিশেষ বিশেষ রাতে। যেমন তাদের বিয়ের রাত।
পারুল সুইচ টিলপ। ফ্যানের শব্দ হচ্ছে। ফ্যান ঘুরছে। সুইচ অফ করতে ইচ্ছা করছে না। ঘুরুক ফ্যান। ইলেকট্রিসিটি খরচ হচ্ছে? হোক না। তাদের তো আর ইলেকট্রিসিটির বিল দিতে হবে না। যার বাড়ি তিনি দেবেন এবং তিনি নিশ্চয়ই লেকট্রিসিটির বিলের মত তুচ্ছ জিনিস নিয়ে মাথা ঘামান না। হয়ত কোনদিন দেখেনও কত বিল এসেছে। পারুল আরেকটা সুইচ টিপল–রকিং চেয়ারের পাশে লম্বা চার ল্যাম্প জ্বলে উঠল। জোর ল্যাম্পের আলো নীলভি। কেমন যেন চাঁদের আলোর ত মায়া মায়া ধরনের আলো। সবগুলি সুইচ টিপে ধরলে কেমন হয়? যার বাড়ি তিনি তো আর আড়াল থেকে লুকিয়ে দেখেছেন না–পারুল কি করছে।
যার বাড়ি তার নাম মেসবাউল করিম। তিনি আছেন হাজার হাজার মাইল দূরে। সুইজারল্যান্ড নামের একটা দেশে। যে শহরে আছেন সে শহরের নাম কেপহর্ন সিটি। সেই সিটি পাহাড়ের উপর। পাহাড়ি বরফে ঢাকা। সবই তাহেরের কাছে শোনা। তাহের এমনভাবে চোখ বড় বড় করে গল্প করে যে পারুলের মনে হয়–সে বোধহয় বরফে ঢাকা কেপহর্ন সিটির পাহাড় নিজে গিয়ে দেখে এসেছে।
বুঝলে পারুলমণি–সে এক দেখার মত দৃশ্য। ঢেউয়ের মত পাহাড়ের সাড়ি। চূড়াগুলি বরফে ঢাকা। পাহাড়ের নিচে ঝাউবন। ঝাউবনের ফাঁকে ফাঁকে ছবির মত সব ভিলা। এরা বলে উইন্টার রিসোর্ট। ঐসব বাড়িতে যারা থাকে তারা কি করে জান? তারা ফায়ার প্রেসে আগুনের সামনে বসে। হাতে থাকে বিয়ারের ক্যান। বিয়ারের ক্যানে একটা করে চুমুক দেয় আর অলস চোখে তাকায় জানালার দিকে…
তুমি জানলে কি করে? তুমি কি দেখেছ কখনো?
সিনেমায় দেখেছি। বুঝলে পারুল, ঐ সব দেশ হচ্ছে যাকে বলে ভূস্বর্গ। আর আমাদের দেশ সেই তুলনায় ভূক। ময়লা নর্দমা। ডাস্টবিনে পচাগলা বিড়ালের। ডেডবড়ি, মুরগীর পাখনা, নাড়িভুড়ি। ফুটপাথগুলি হচ্ছে–হোমলেস মানুষের লেট্রিন। কোন সুন্দর দৃশ্য বলে কিছু নেই।
চল এক কাজ করি, এই দেশ ছেড়ে সুন্দর কোন দেশে চলে যাই।
তাহের কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ক্ষুব্ধ গলায় বলল, ঠাট্টা করছ? তোমাকে না বলেছি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করবে না। ঠাট্টা করলে মনে কষ্ট পাই।
ঠাট্টা না। একদিন আমাদের প্রচুর টাকা হবে। লক্ষ লক্ষ টাকা। তখন আমরা। একটা ঝাড়বাতি কিনব। ঝাড়বাতিটা সঙ্গে নিয়ে এই দেশ ছেড়ে দূরের কোন সুন্দর দেশে চলে যাব।
তোমার মাথাটা খারাপ পারুল। সত্যি খারাপ।
পারুল সব কটা সুইচ জ্বালিয়ে দিল। বসার ঘটা এখন আলোয় আলোয় ঝলমল করছে। সুন্দর লাগছে। পারুল নীল রঙের রকিং চেয়ারটায় বসল। চেয়ারটা। আপনাআপনি দুলছে। পারুলের মনে হল, এখন যদি কোন কারণে তাহেরের ঘুম ভেঙে যায়, সে ভয়ানক অবাক হবে। পারুলের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলবে–তোমার মাথাটা খারাপ পারুল। তোমার মাথাটা সত্যি খারাপ।
যার বাড়ি তিনি যদি পারুলকে দেখেন তাহলে তিনি কি ভাববেন? ধরা যাক, তিনি কেপহর্ন সিটি থেকে বাংলাদেশে চলে এসেছেন। পেন থেকে নেমে বিকল্প ট্যাক্সি ভাড়া করে সোজা চলে এসেছেন। দারোয়ান গেট খুলে দিয়েছে। তিনি গেটের ভেতর ঢুকে হতভম্ব হয়ে গেলেন, কারণ ড্রয়িং রুমের সব বাতি জ্বলছে। তিনি দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলেন, এই বাতি জ্বলছে কেন? দারোয়ান বলল, জানি না, স্যার।