ওকে অভ্যস্ত করে দিচ্ছি, জন্মের পর তো ওকে খেয়ে না খেয়েই কাটাতে হবে। জন্মের আগেই অভ্যস্ত হয়ে পৃথিবীতে আসুক।
পারুল চায়ের কেতলি চাপিয়ে উঠে দাঁড়াল। তাহের বলল, কোথায় যাচ্ছ?
ওদের জন্যে একটু টক দৈ নিয়ে আসি। চিনি মাখিয়ে দিলে ওরা নিশ্চয়ই খাবে। খাবে না?
তাহের কিছু বলল না। সে মোটামুটি নিশ্চিত পারুলের মাথাটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
এ বাড়িতে তাকে আর রাখা যাবে না। অন্য কোথাও নিয়ে যেতে হবে। কোথায় নিয়ে যাবে? গ্রামের বাড়িতে? বসতবাড়ি তো এখনো আছে। চারদিকে জঙ্গল-টঙ্গল হয়ে সাপখোপের আড্ডা হয়েছে। সাফ-সুতরা করে মোটামুটিভাবে বাসযোগ্য কি করা যাবে না?
বড় একটা বাটি ভর্তি টক দৈ নিয়ে পারুল কুকুর তিনটাকে খাওয়াচ্ছে। শুধু যে খাওয়াচ্ছে তাই না, গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বিড় বিড় করে খুব নিচু গলায় কি বলছে। কি বলছে তাহের শুনতে পাচ্ছে না। পারুল কথা বলছে প্রায় ফিস ফিস করে। দৈ খেতে খেতে মাঝে মাঝে মুখ তুলে তারা এমন ভঙ্গিতে পারুলকে দেখছে যে, তাহেরের মনে হল ওরা মন দিয়ে পারুলের কথা শুনছে।
তাহের কান পেতে আছে–পারুলের কথা শোনার চেষ্টা করছে। পারুল শুধু কথা বলছে তাই না–মাঝে মাঝে হাসছেও। আশ্চর্য কাণ্ড।
তোর কবিতা শুনবি? আমি একটাই কবিতা জানি–রবিঠাকুরের দুই বিঘে জমি। শুনবি? গোটা কবিটাই আমার মুখস্থ।
তাহের হতভম্ব হয়ে শুনছে সত্যি সত্যি পারুল বিড় বিড় করে কবিতা আবৃত্তি করছে। কুকুর তিনটাও মনে হচ্ছে আগ্রহ করে কবিতা শুনছে।
ভদ্রতার প্রশ্ন
রহমান সাহেব আজ তাহেরকে দেখামাত্র চিনলেন। হাতের ফাইল বন্ধ করে বললেন, ও তুমি।
তাহের বলল, স্যার কেমন আছেন?
ভদ্রতার প্রশ্ন। এই প্রশ্ন করার কোন অর্থ হয় না, তবু করতে হয়। সামাজিক শ্রেণীবিন্যাসে একটু উপরে যাদের অবস্থান তারা নিচের অবস্থান থেকে আসা এই প্রশ্নের জবাব দেন না। রহমান সাহেবও দিলেন না। তাহের বলল, বড় সাহেব কবে আসবেন একটু খোঁজ নিতে এসেছিলাম স্যার।
বোস।
তাহের হকচকিয়ে গেল। ম্যানেজার সাহেব তাকে বসতে বলবেন ভাবাই যায় না। হঠাৎ করে তিনি এই বাড়তি খাতির কেন করছেন তা বুঝতে না পেরে তাহের খানিকটা ঘাবড়ে গেল।
দাঁড়িয়ে আছ কেন, বোস।
তাহের বসল। রহমান সাহেব বললেন, স্যারের কাছে থেকে ফ্যাক্স পেয়েছি, তাঁর আসতে দেরি হবে।
কতদিন দেরি স্যার?
কতদিন দেরি এইসব কিছু লেখা নেই। উনার শরীর ভাল যাচ্ছে না। ফুল মেডিকেল চেক-আপ করবেন। তোমাকে আরো এক মাসের খরচ দিতে বলেছেন। আমি ক্যাশিয়ারকে বলে দিয়েছি, তুমি তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যেও।
তাহের তো তোমার নাম?
জ্বি স্যার।
কিছু মনে করো না তাহের, বড় সাহেবের সঙ্গে তোমার কি কোন আত্মীয়তা আছে?
জি না। একই গ্রামে বাড়ি।
আচ্ছা।
স্যার, আমি উঠি?
একটু বোস, কি একটা কথা তোমাকে যেন বলতে চাচ্ছিলাম… ভুলে গেলাম, মনে পড়ছে না। একুট বস, দেখি মনে পড়ে কি না।
তাহের অস্বস্তি নিয়ে বসে রইল। ম্যানেজার সাহেব ভুরু কুঁচকে রাখলেন। তিনি আজ শেভ করেননি। খোঁচা খোঁচা কাঁচা-পাকা দাড়ি বের হয়ে এসেছে। তাকে বুড়ো বুড়ো লাগছে।
ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। আচ্ছা শোন, তুমি কি তোমার স্ত্রীকে নিয়ে ঐ বাড়িতে উঠেছ না কি?
তাহের খুক খুক করে কাশল। রহমান সাহেব সরু চোখে তাকালেন, আমি খবর পেয়েছি তুমি তোমার স্ত্রীকে নিয়ে উঠেছ। নিজেদের ঘরবাড়ি করে নিয়েছ।
কথাটা সত্যি না স্যার।
তুমি তাহলে স্ত্রীকে নিয়ে উনি?
উঠেছি স্যার।
তাহলে কথাটা সত্যি না বললে কেন?
তাহের হড়বড় করে বলল, আমি একা একা থাকি–কিভাবে থাকি দেখতে এসেছিল। আমি বললাম, দু-একটা দিন থাক আমার সঙ্গে…
কাজটা খুবই অন্যায় করেছ। আজ দিনের মধ্যে তুমি তোমার স্ত্রীকে সরিয়ে দেবে। স্যারের বাড়ি অন্যের সংসার পাতার জন্যে না। বুঝতে পারছ?
পারছি স্যার।
আমি তো খবর শুনে হতভম্ব। স্ত্রীকে নিয়ে বাস করছ–ভাল কথা, স্যারের শোবার ঘরে না কি রাতে ঘুমাও?
তাহের শুকনো মুখে বলল, জ্বি না স্যার। এই মিথ্যা কথাটা বলতে তার খুব কষ্ট হল। মিথ্যা বলা তাহেরের একেবারেই অভ্যাস নেই। মিথ্যা বলতে গেলেই কথা জড়িয়ে যায়। রহমান সাহেব বললেন, আমি অবশ্যি কামরুলের কথা বিশ্বাস করিনি। সে এক আধা পাগল। স্যারের শোবার ঘর চাবি দেয়া, সেখানে ঢুকবে কিভাবে? কামরুল এইসব বানিয়ে বানিয়েই বলেছে তা বুঝতে পেরেছি। যাই হোক, আজ দিনের মধ্যেই তোমার স্ত্রীকে অন্য কোথাও রেখে আসবে।
জি আচ্ছা। স্যার, আমি যাই।
যাও।
তাহের উঠে দাঁড়াল। রহমান সাহেব ফাইল খুলতে খুলতে বললেন, আজ রাতে আমি একবার তোমাদের এখানে যাব। স্বচক্ষে দেখে আসব।
জি আচ্ছা স্যার।
সন্ধ্যাবেলা গিয়ে যেন না দেখি তুমি তোমার স্ত্রীকে নিয়ে সংসারধর্ম করছ।
তাহের ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলল। নিঃশ্বাস ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই তার মাথা ধরে গেল। দুঃশ্চিন্তার মাথা ধরা। দুঃশ্চিন্তা না কাটা পর্যন্ত এই ব্যথা কমবে না।
ম্যানেজার সাহেব বললেন, যাও, দাঁড়িয়ে আছ কেন? কিছু বলবে?
জি না।
তাহের এখন কি করবে? সিরাজ সাহেবের বাসায় যাবে? আজ তো যাওয়াই যাবে না। কাল যদি মেয়ের গায়ে হলুদ হয়ে থাকে আজই বোধহয় বিয়ে। বিয়েবাড়িতে সে তার বৌ নিয়ে উঠবে? এটাও মন্দ না। বিয়ে উপলক্ষে সে তার বৌ নিয়ে উঠল। বিয়েশাদীতে আত্মীয়স্বজনরা স্ত্রী-পুত্র নিয়ে বিয়েবাড়িতে উপস্থিত হয়। কয়েক দিন থাকে। এটা ছাড়া সে আর কি করতে পারে? জসিমের মেসে যাবে? সে একা হলে জসিমের কাছে যাওয়া যেত। স্ত্রী নিয়ে যাবে কিভাবে? পারুলের বড় চাচার সঙ্গে দেখা করতে পারে। বাসায় না গিয়ে উনার অফিসে চলে গেলে কেমন হয়? অফিসে তিনি তো আর রাগারাগি করতে পারবেন না। অফিস থেকে বের করে দিতে পারবেন না।