কাউকে জিজ্ঞেস করনি?
ম্যানেজার সাহেবের কাছে তিনবার গেলাম। যতবার যাই উনি বলেন–পরে আস।
তোমাকে তুমি করে বলেন?
হুঁ।
পারুল হালকা গলায় বলল–তুমি করেই তো বলবে। বাড়ির দারোয়ানকে ম্যানেজার জাতীয় মানুষরা তুই করে বলে–তোমাকে তাও খানিকটা সম্মান দেখাচ্ছে।
তাহের চুপ করে আছে। গভীর মনোযোগে পরোটা ভাজা দেখছে। ভাজা পরোটার খিদে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে–পারুলের কোন কথা এখন আর তার মাথায় ঢুকছে না।
ম্যানেজার সাহেব তোমাকে তাহলে কিছু বলেন নি?
না।
তার মানে হচ্ছে করিম ভাইয়ার প্রোগ্রামের পরিবর্তন হয়েছে। উনি আসছেন না। আসতে দেরি হবে। দুএকদিনের মধ্যে তার আসার কথা থাকলে ম্যানেজার সাহেব তোমাকে অবশ্যি জানাতেন। কারণ তোমাকে বাড়ি খালি করতে হবে…
কথাটা তো তুমি ভালই বলেছ।
ম্যানেজার সাহেবের নাম কি?
লুৎফুল কবীর। সিরাজগঞ্জ বাড়ি।
কবীর ভাইয়ার সঙ্গে তুমি কাল আবার দেখা করবে। আরো কতদিন তোমাকে বাড়ি পাহারা দিতে হবে জেনে আসবে। বাড়তি দিনগুলির জন্যে খরচ চাইবে। মনে থাকবে?
হুঁ।
পারুল তাহেরের খাওয়া দেখছে। গরম পরোটা ছিঁড়ে ছিঁড়ে মুখে দিচ্ছে। গরমের জন্যে ঠিকমত চিবুতেও পারছে না। গিলে ফেলছে। আহ, বেচারার এতটা খিদে লেগেছে।
তাহের বলল, একা একা সারাদিন ছিলে, ভয় লাগেনি তো!
ভয় লাগবে কেন?
আমি প্রায়ই একা এই বাড়িতে থাকতাম, তখন ভয় ভয় লাগত।
কিসের ভয়? ভূতের?
জানি না কিসের। কুকুর তিনটাকে বেশি ভয় লাগত–এরা ডেঞ্জারাস। একটা মানুষ মারল একবার।
বল কি। কবে?
গত বৎসর। দেয়াল টপকে চোর ঢুকেছিল। চোর বেচারা জানত না এমন ভয়ংকর কুকুর আছে। ঝপ করে নিচে পড়েছে, ওম্নি কুকুর তিনটা তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ছিঁড়ে খুঁড়ে শেষ করে দিয়েছে। চিৎকার করারও সময় পায়নি।
এই নিয়ে কিছু হয়নি?
না। কি হবে? একটা মানুষ মারা গেছে এটা কেউ বুঝতেও পারেনি। বড় সাহেব পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে রাতের বেলা ডেডবডি পার করে দিলেন। টাকাওয়ালা মানুষদের কখনো কোন সমস্যা হয় না।
আরেকটা পরোটা ভেজে দেব, খাবে?
দাও।
রাতে তাহলে কিন্তু ভাত খেতে পারবে না।
থাক, আজ তাহলে পরোটাই খাই–রাতে টক দৈ খেয়ে শুয়ে পড়ব।
পারুল মাথা নিচু করে হাসছে। তাহের বিস্মিত হয়ে বলল, হাসছ কেন?
মজার একটা কথা ভেবে হাসছি।
আমাকে বল, আমিও হাসি।
তোমার শুনে হাসি আসবে না। সবাই সব ব্যাপারে হাসে না। কেউ কেউ হাসির শুনে রেগে যায়। তুমিও এই কথাটা শুনে রেগে যাবে।
হাসির কথা শুনে রাগব কেন? এইসব তুমি কি বল? কথাটা কি?
কথাটা হচ্ছে–কুকুর তিনটাকে দিয়ে আমরা কিন্তু অনেক মজা করতে পারি। যেমন, প্রথমে ওদের দিয়ে কুকুরের সর্দার কামরুলকে মেরে ফেললাম। ইশারা করলাম, ওরা ছুটে গিয়ে কামরুলকে ছিঁড়ে খুঁড়ে খেয়ে ফেলল। তারপর খোঁজ নিতে এলেন ম্যানেজার সাহেব কবীর ভাইয়া–যে তোমাকে তুমি করে বলে, আবারও ইশারা করলাম, ওরা কবীর–ভাইয়ার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, তাকেও খেয়ে ফেলল … এক সময় এলেন মহা ক্ষমতাবন মেসবাউল করিম। আমি আবারও…
চুপ কর তো।
পারুল হাসছে। শব্দ করে হাসছে। তাহের কঠিন গলায় বলল, হাসি বন্ধ কর।
পারুল চেষ্টা করেও হাসি বন্ধ করতে পারছে না। তার হাসি বেড়েই যাচ্ছে। সে কোন মতে বলল, বললাম না হাসির কথা শুনে তুমি রেগে যাবে। এই তো রেগে গেছ।
এর মধ্যে হাসির কি আছে?
অনেক কিছুই আছে।
তাহের চিন্তিত মুখে পারুলের দিকে তাকিয়ে আছে। পারুলের কি মাথাটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে? অভাবে, দুঃখে, দুঃশ্চিন্তায় মাথা এলোমেলো হয়ে যাওয়া অসম্ভব না। এখনো হাসছে। মুখে শাড়ির আঁচল চাপা দিয়ে এখন অবশ্যি হাসি চাপা দেবার চেষ্টা করছে, পারছে না।
হাসির শব্দে আকৃষ্ট হয়েই হয়ত কুকুর তিনটা ছুটে এসেছে। লোহার গ্রীলের ফাঁক দিয়ে মাথা গলিয়ে দিয়েছে। তারাও তাহেরের মতই বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে। পারুল হাসি থামিয়ে কুকুর তিনটার দিকে তাকিয়ে বলল, কি রে, তোরা কেমন আছিস? তোরা তো আর কথা বলতে পারিস না, লেজ নেড়ে বল, ভাল আছিস।
তিনজনই লেজ নাড়ছে। পারুল তাহেরের দিকে তাকিয়ে উজ্জ্বল মুখে বলল, দেখছ, ওরা আমার কথা বুঝে। ওদের আমি যা করতে বলব তাই ওরা করবে। কিরে, তোরা আমার কথা শুনবি না?
কুকুর তিনটির ভেতর থেকে চাপা এক ধরনের শব্দ বের হল। তারা আবারও লেজ নড়ল। পারুল বলল, তোরা কিন্তু খাবি?
তাহের রাগী গলায় বলল, তোমার হয়েছেটা কি? তুমি কুকুরের সঙ্গে কথা বলছ কেন?
পারুল তাহেরের প্রশ্ন সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বলল, আচ্ছা, এই তিন অতিথিকে কি খেতে দেয়া যায় বল তো? টক দৈ দেব? কুকুর কি টক দৈ খায়?
তাহের বিরক্ত গলায় বলল, টক দৈ খায় কি না জানি না, গু খেতে দেখেছি। টক দৈ খেতে কখনো দেখিনি।
পারুল উজ্জ্বল চোখে বলল, ওরা কি দুধ খায়? দুধ খেলে দৈও খাবে। কুকুরকে তুমি কখনো দুধ খেতে দেখেছ? আমি দেখিনি। আমি বিড়ালকে দুধ খেতে দেখেছি। বিড়াল যখন খায় তখন নিশ্চয়ই কুকুরও খাবে, তাই না?
বিড়াল খেলেই কুকুর খাবে এটা কেমন মুক্তি? কুকুর মানুষের গু খুব আরাম করে খায়। বিড়াল খায় না।
তুমি বার বার একটা বাজে প্রসঙ্গ টেনে আনছ কেন? চা খাবে?
না
এরকম রেগে গেলে কেন? খাও না একটু চা। তোমার সঙ্গে আমিও খাব। জান, আজ সারাদিন আমিও কিছু খাইনি।
সে কি!
শরীরটা ভাল ছিল না।
তাহের উদ্বিগ্ন গলায় বলল, শরীর ভাল না থাকলেও খেতে হবে। তুমি না খেলে পেটে যে আছে সে পুষ্টি পাবে কোত্থেকে?