কেউ জবাব দিল না। জবাব দেবার কথাও না। কেউ যদি ফুটোর ওপাশে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকে সে চুপ করেই থাকবে। মনে মনে খিক খিক করে হাসবে–ডাকলে সাড়া দেবে না।
পারুল হাত বাড়িয়ে কাপড় নিল। নিজেকে ঢাকিল। তার এখন কান্না পাচ্ছে। চোখে পানি আসছে না, কিন্তু চোখ জ্বালা করছে। লজ্জা ও অপমানে শরীর কাঁপছে—শরীর অশুচি মনে হচ্ছে। পারুল গোসলখানা থেকে বের হয়ে এল। না, আশেপাশে কেউ ইি। হালকা পায়ের শব্দ কি পারুল পাচ্ছে? যেন কেউ একজন স্যান্ডেল পায়ে সরে যাচ্ছে। স্যান্ডেলের ফট ফট শব্দ।
বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে বা দিকের আম গাছের নিচে রাখা পাথরগুলির উপর বসে আছে কামরুল। সে তাকিয়ে আছে অন্যদিকে। কুকুর তিনটা আশেপাশে নেই। দিনের বেলা বেশির ভাগ সময়ই তারা বাঁধা থাকে। আজও মনে হয় বাঁধা।
পারুল তোয়ালে দিয়ে ভেজা চুল জড়াল। তারপর নেমে গেল বাগানে। তার পায়ে স্যান্ডেল। সে স্যান্ডেলে শব্দ করতে করতে এগুচ্ছে। তারপরেও কামরুল তার দিকে ফিরছে না।
শুনুন তো।
কামরুল তাকাল। টকটকে লাল চোখ। এই মানুষটার চোখ কি আগেও এমন লাল ছিল? পারুল লক্ষ্য করেনি।
আপনি একটু আগে কোথায় ছিলেন?
কামরুল তাকিয়ে আছে। জবাব দিচ্ছে না। তাকে খুব বিচলিতও মনে হচ্ছে না। মাশলাইয়ের কাঠি দিয়ে দাঁত খুটছে। কামরুল পিচ করে থুথু ফেলল। সেই আগের ত থুথু চোয়ালে লেগে আছে।
কথা বলছেন না কেন? একটু আগে আপনি কোথায় ছিলেন?
তা দিয়া তোমার কি দরকার?
দরকার আছে। আপনি কি বাথরুমের ফুটো দিয়ে আমাকে দেখার চেষ্টা করেছেন?
তোমায় দেইখ্যা আমার লাভ কি?
লাভ-লোকসানের কথা না–আপনি আমাকে দেখার চেষ্টা করেছেন কি না বলুন।
কামরুল আবার পিচ করে থুথু ফেলল। এবারের থুথু এসে পড়ল পারুলের পায়ের কাছে। সে এখনো নির্বিকার ভঙ্গিতে দেয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে দাঁত খুঁচাচ্ছে।
পারুল কি করবে? সে কি লোকটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে, না কি সে ফিরে যাবে নিজের ঘরে? দাঁত খুটাতে খুটাতে লোকটা নিজের মনে হাসছে। হাসির দমকে তার শরীর একটু কেঁপে উঠল। পারুলের সারা শরীর কাঁপছে। আর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে সে সত্যি সত্যি লোকটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। আর দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক না। পারুল ফিরে যাচ্ছে ঘরের দিকে। সামান্য রাস্তা সে যেতে পারছে না। পা মনে হচ্ছে পাথরের মত ভারি। টেনে টেনে পা ফেলতে হচ্ছে।
কামরুল সত্যি সত্যি হাসছে। হাসির খিক খিক শব্দ আসছে। পারুল পেছনে ফিরল না। পারুল আবার বাথরুমে ঢুকে গেল। তার মুখ ভর্তি করে বমি আসছে। সমস্ত শরীর যেন কেমন করছে। সে কি মারা যাচ্ছে। শীত লাগছে। প্রচণ্ড শীত লাগছে। বাথরুম থেকে বের হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়তে হবে। গায়ে একটা ভারী কম্বল দিতে হবে। দরজা খুব শক্ত করে বন্ধ করতে হবে। আচ্ছা, কুকুর তিনটা কোথায়? ওরা কি তার বিপদে পাশে এসে দাঁড়াবে না? ওদের নামগুলি কি? নাম মনে পড়ছে না। একজনের নাম কি সে? উহুঁ, সেন্টু না। সেন্টু তার ফুপাতো ভাইয়ের নাম।
দরজায় টক টক শব্দ হচ্ছে। পারুল ভাবছিল লালটা বোধহয় স্বপ্নের মধ্যে হচ্ছে। না, স্বপ্ন না। এখন সে জেগে আছে। তার সারা গা ঘেমে আছে। ঘর অন্ধকার। মাথার উপর শোঁ শোঁ শব্দে ফ্যান ঘুরছে।
পারুল! পারুল। কি হয়েছে তোমার?
তাহেরের গলা। কতক্ষণ হল সে এসেছে? ঘর এমন অন্ধকার কেন? সে কি ঘুমিয়ে পড়েছিল? ঘুমের মধ্যেই রাত হয়ে গেছে? কত রাত? পারুল ধড়মড় করে উঠে বসল, ক্ষীণ স্বরে বলল, কে?
আমি। আমি … কি ব্যাপার পারুল?
পারুল দরজা খুলল। তাহের উদ্বিগ্ন গলায় বলল, অসুখ-বিসুখ নাকি? অনেকক্ষণ ধরে দরজা ধাক্কাচ্ছি।
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
পারুল বাতি জ্বালাল। সে এখনও পুরোপুরি ধাতস্থ হয়নি। এখনও নিজের কাছে সব এলোমেলো মনে হচ্ছে–এটা কাদের বাড়ি? তাদের নিজেদের? তাহের আবারও বলল, পারুল, কি হয়েছে?
কিছু না।
শরীর খারাপ?
হুঁ।
ভাত আছে? দুপুরে কিছু খাইনি–দারুণ খিদে লেগেছে।
পারুল নিজেকে সামলে নিয়েছে। দুপুরের ঘটনাটা সে অতি দ্রুত মাখা থেকে মুছে ফেলে স্বাভাবিক হয়ে গেল। সে তাহেরের দিকে তাকিয়ে হাসল। সহজ গলায় বলল, ভাত ঠাণ্ডা কড়কড়া। গরম করলে খেতে পারবে না। পরোটা বানিয়ে দেই?
দাও। তোমার হাতে এটা কিসের হাড়ি–মিষ্টির?
টক দৈ।
টক দৈ কি জন্যে?
তাহের জবাব দিল না। হাত-মুখ ধুতে গেল। তার ভাত খেতেই ইচ্ছা করছে। খিদে যা লেগেছে তাতে ঠাণ্ডা-গরম কিছুই বোঝা যাবে না–পরোটা বানাতে দেরি হবে। হোক দেরি–পরোটা বানানোর সময় সে পাশে মোড়ায় বসে থাকবে–টুকটাক গল্প করবে। এও মন্দ না। স্ত্রীর সঙ্গে গল্প করতে তার ভাল লাগে। সব সময় না—পারুল যখন কোন কাজকর্মে ব্যস্ত থাকে তখন পারুলের ব্যস্ত ভঙ্গির কাজকর্ম দেখতে তার ভাল লাগে কেন কে জানে।
পারুল ময়দা মাখছে। তাহের পাশে বসে আছে। ময়দা মাখার মত অতি সাধারণ একটা দৃশ্যও তার দেখতে ভাল লাগছে।
পারুল বলল, করিম ভাইয়া কবে আসছেন?
তাহের বিস্মিত হয়ে বলল, করিম ভাইয়াটা কে?
মেসবাউল করিম, এই বাড়ির মালিক।
তাহের বিস্মিত হয়ে বলল, তাকে করিম ভাইয়া বলছ কেন?
বয়সে বড়, এই জন্যেই বলছি।
সম্মানিত লোক, এদের নিয়ে ঠাট্টা-ফাজলামি করা ভাল না।
ভাইয়া ডাকছি। ঠাট্টা ফাজলামি তো করছি না। উনি কবে আসছেন?
বুঝতে পারছি না। মনে হয় না উনি আসছেন। উনি আসার আগে অফিসে সাজ সাজ রব পড়ে যায়। আজ দেখলাম অফিস ঠাণ্ডা।