তাহের হকচকিয়ে গেল। মামা তাকে চিনতে পারছেন না। এই কয়েক দিনে তাকে বেমালুম ভুলে যাওয়াটাও খুবই অস্বাভাবিক। তাহেরের ক্ষীণ সন্দেহ হল–মামা হয়ত তাকে ইচ্ছে করেই চিনতে পারছেন না। সে শুকনো মুখে বলল, মামা, আমি তাহের।
ভাল আছ বাবা?
জি মামা, ভাল–বাড়িতে কি কোন উৎসব?
মীনার গায়ে-হলুদ–বরপক্ষের এরা এক কাতল মাছ এনেছে, একান্ন কেজি ওজন–যাও মাছটা দেখে আস। মাছের সাথে ছবি তুলবে? ছবি তুলতে চাইলে তোল। ভিডিও করতে চাইলে ভিডিওওয়ালাদের বলো। ভিডিও করবে।
তাহের পুরোপুরি নিশ্চিত হল সিরাজউদ্দিন সাহেব তাকে চিনতে পারছেন না। একান্ন কেজি ওজনের কাতল মাছের প্রতিও সে আগ্রহ বোধ করছে না। ছবি তোলার তো প্রশ্নই আসে না …।
সিরাজউদ্দিন হাসিমুখে বললেন, জামাই কাস্টমে আছে কাঁচা পয়সা। কাঁচা পয়সা না থাকলে একান্ন কেজি ওজনের মাছ কেউ আনে? তুমি বস, দাঁড়িয়ে আছ কেন?
আমার একটা কাজ আছে মামা–পরে আসব।
আচ্ছা আচ্ছা।
মামা, আমাকে কি চিনতে পেরেছেন?
হ্যাঁ, চিনতে পেরেছি। চিনতে পারব না কেন?
পারুল এবং আমি অনেকদিন ছিলাম আপনার এখানে।
ও আচ্ছা। ভাল। খুব ভাল।
তাহের দৈ-এর হাড়ি নিয়েই বের হয়ে এল। বিয়ে বাড়ির এই হৈচৈ-এর মধ্যে এক হাড়ি টক দৈ রেখে আসার প্রশ্নই ওঠে না। এরা হাড়ি খুলেও দেখবে না। এরচে বরং পারুলকে দিলে কাজ হবে। দৈ-এ নিশ্চয়ই অনেক পুষ্টি আছে। এই সময় পুষ্টিকর খাবার দরকার।
মতিঝিল অফিসের ম্যানেজার রহমান সাহেব চশমার ফাঁক দিয়ে অনেকক্ষণ তাহেরর দিকে তাকিয়ে রইলেন। মনে হল সিরাজউদ্দিন সাহেবের মত তিনিও তাকে চিনতে পারছেন না।
স্যার, আমি তাহের। নীল হাউসের দেখাশোনা করছি।
কি চাই?।
বড় সাহেব কখন আসবেন এটা জানার জন্যে…
রহমান সাহেব চশমার ফাঁক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন। হাতের ফাইলপত্র দেখতে লাগলেন। তার সামনে খালি চেয়ার আছে কিন্তু তিনি বসতে বলছেন না…।
কোন ফ্লাইটে আসছেন খবর পেয়েছেন স্যার?
ঘণ্টাখানিক পরে আস। হাতের কাজটা সেরে নেই। কাজের সময় তোমরা বিরক্ত কর। আশ্চর্য!
দৈ—এর হাড়ি হাতে নিয়ে এক ঘণ্টা বসে থাকা খুব সমস্যা। সমস্যা হলেই কি। বসে থাকতেই হবে। রহমান সাহেবের হাতে এমন কোন কাজ নেই যে, বড় সাহেব কোন ফ্লাইটে আসছেন এই বাক্যটা বলা যাবে না। হাজারো কাজের মধ্যেও বলে ফেলা। যায়। না বললে করার কিছু নেই। এক ঘণ্টা পরে যেতে বললে–এক ঘণ্টা পরেই যেতে হবে।
তাহের এক ঘণ্টা সাত মিনিট পর আবার ঢুকল। আবারও রহমান সাহেব চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে রইলেন। মনে হচ্ছে চিনতে পারছেন না। এর মধ্যে ভুলে গেছেন।
কি ব্যাপার?
স্যার, বড় সাহেব কখন আসবেন?
বললাম না একটু পরে আসতে–কাজ করছি।
জি আচ্ছা, স্যার।
লাঞ্চের পরে আস।
জি আচ্ছা।
লাঞ্চের অনেক দেরি। এতক্ষণ তাহের কোথায় বসবে? রিসেপশনিস্টের ঘরে বসা যায়। রিসেপশনিস্ট মেয়েটি অতিরিক্ত সুন্দর। এত সুন্দর মেয়ের সামনে মূর্তির মত দীর্ঘ সময় বসে থাকা যায় না। মেয়েটা কোন কথা বলে না। সবার দিকেই অবজ্ঞা এবং অবহেলার ভঙ্গিতে তাকায়। নিজের মনেই কিছুক্ষণ পর পর ভ্যানিটি ব্যাগ বের করে ঠোঁটে লিপিস্টিক দেয়।
তাহের দৈ—এর হাড়ি হতে রিসেপশনিস্টের ঘরে ঢুকল। মেয়েটা সরু চোখে বলল, কি ব্যাপার?
একটু বসব।
মেয়েটা অসম্ভব বিরক্ত মুখে ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে লিপিস্টিক বের করছে।
তাহের মনে করতে পারছে না পারুল ঠোঁটে লিপিস্টিক দেয় কি না। মনে হয় দেয়। লিপিস্টিকের নিশ্চয়ই অনেক দাম। মেয়েটার গায়ে সবুজ শাড়ি। ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপিস্টিক। সবুজ এবং লালে কি সুন্দর যে মেয়েটাকে লাগছে…।
এই যে, শুনুন।
তাহের মেয়েটির কথা শুনে এমন চমকে উঠল যে, কোল থেকে দৈ-এর হাড়ি পড়ে যাবার জোগাড় হল। মেয়েটি কঠিন গলায় বলল, আপনি এভাবে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবেন না। এটা অসভ্যতা। এখানে শুধু শুধু বসেই-বা আছেন কেন?
ম্যানেজার সাহেবের সঙ্গে একটা কথা আছে।
ক্যান্টিনে গিয়ে বসুন।
জ্বি আচ্ছা।
খুব অপমানিত বোধ করার কথা–তাহের বোধ করছে না। সম্ভবত তার গায়ের চামড়া মোটা হয়ে গেছে। একবার চামড়া মোটা হতে থাকলে মোটা হতেই থাকে। এক সময় সেই চামড়া গণ্ডারের চামড়াকেও ছাড়িয়ে যায়। তাহেরের মনে হল–কিছুদিন পর কেউ অকারণে তার গায়ে থুথু দিলেও সে নির্বিকার থাকবে।
ক্যান্টিনে ঢুকে তাহের এক কাপ চায়ের অর্ডার দিল। চা জিনিসটা তার কাছে অসহ্য। অসহ্য হলেও খেতে হবে–শুধু শুধু তো ক্যান্টিনে বসে থাকা যায় না। মনে হচ্ছে আজও দেরি হবে। ভাত না খেয়ে পারুল অপেক্ষা করবে। খাওয়ার সময় পার হয়ে যাবে–আর কিছু খাবে না। অথচ এই সময়ই খাওয়া-দাওয়া ঠিকমত করা উচিত। তাহের চিন্তিত মুখে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। পারুলের জন্যে হঠাৎ তার মনটা কেমন করছে। বাইরে বের হলে সচরাচর পারুলের কথা তার মনে পড়ে না। হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে, তখন মনটা খুব অস্থির লাগে। তার খুব অস্থির লাগছে…
পারুল অনেকক্ষণ ধরে গোসলখানায়। গোসলখানাটা ছোট এবং স্যাঁতস্যাঁতে। মেঝেতে শ্যাওলা পড়ে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে আছে। অসম্ভব পিছল। পা টিপে টিপে হাঁটতে হয়। শরীরের এই অবস্থায় পা পিছলে পড়া বিপজ্জনক হবে। পারুল শ্যাওলা ধরা মেঝেতেই পা ছড়িয়ে বসেছে। তার সামনে গামলা ভর্তি পানি। মগে করে এক মগ পানি সে মাথায় ঢালল। শরীর কেঁপে উঠল। কি ঠাণ্ডা পানি। ঠাণ্ডার প্রথম ধাক্কাটা কেটে গেলে হিমশীতল পানিতে নাওয়ার মত আনন্দ আর কিছুতেই নেই। এক পর্যায়ে নেশার মত লাগে। তবে গায়ে ভেজা কাপড় থাকলে হয় না ভেজা কাপড়ে শীত বেশি লাগে। বরফের মত ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করতে হয় সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে। পারুল তার গায়ের কাপড় খুলে ফেলল। অন্ধকার বন্ধ গোসলখানা, নিজেকে দেখা যাবে এমন কোন আয়না পর্যন্ত নেই–এখানে নগ্ন হতে বাধা নেই। পারুল তার গায়ে পানি ঢালছে। তার। নেশার মত লাগছে। গামলার পানি শেষ হয়ে গেল। চৌবাচ্চায় পানি ভর্তি। চৌবাচ্চায় নেমে গেলে কেমন হয়? সারা শরীর ডুবিয়ে শুধু মাখাটা বের করে রাখবে। অনেক পানি। নষ্ট হবে–হোক না। পারুল উঠে দাঁড়াল আর তখনি তার বুকে একটা ধাক্কার মত লাগল। মনে হল কে যেন তাকে দেখছে। বাথরুমের কোন ফুটো, কোন ফাঁক-ফোকর দিয়ে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। পারুল চারদিকে তাকাল। না, কোথাও কোন ফুটো চোখে পড়ছে না। এটা নিশ্চয়ই তার মনের ভুল। কিন্তু তার শরীর ঝিম ঝিম করছে। কেউ একজন অবশ্যই তাকে দেখছে। পারুল কঁপা কাঁপা গলায় বলল, কে?