উহুঁ।
উই মানে, পানি খাব না?
খাবে, তবে এখানে না। আজ আমরা এ ঘরে ঘুমুব না।
কোথায় ঘুমুব?
মাস্টার বেডরুমে।
তাহের চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। পারুল তার দিকে খানিকটা ঝুঁকে এসে স্বাভাবিক গলায় বলল, এ বাড়ির মাস্টার বেডরুমের তালা আমি খুলে ফেলেছি। তুমি দুপুরে এলে না। আমার কিছু করার ছিল না। তখনি কাজটা করলাম। চুলের কাটা দিয়ে খুললাম।
মাস্টার বেডরুমের তালা খুলে ফেলেছ?
হুঁ।
কেন?
ওখানে ঘুমুব। ওয়াটার বেডে শুয়ে দেখি কেমন লাগে। বাড়ি তো কাল ছেড়েই দিতে হবে—শখ মিটিয়ে যাই।
তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে পারুল।
মাথা মোটেই খারাপ হয়নি। আমার মাথা ঠিক আছে।
উহুঁ। তুমি যে সব কাণ্ডকারখানা করছ–কোন সুস্থ মানুষ তা করবে না–অন্যের ঘর, অন্যের বাড়ি…
অন্যের বাড়ি খানিকক্ষণের জন্যে নিজের হয়ে যায়। তাতে দোষের হয় না। মেসবাউল করিম সাহেব এই বাড়ি দেখাশোনার জন্যে যখন তোমার কাছে দিয়েছেন তখন নিশ্চয়ই বলেছেন, নিজের বাড়ি মনে করে এই বাড়ির যত্ন করবে। বলেননি?
হুঁ।
কাজেই আমরা এক রাতের জন্যে এই বাড়িটাকে নিজের বাড়ি মনে করছি।
তাহের চিন্তিত গলায় বলল, কামরুল স্যারের কাছে লাগাবে।
লাগালে লাগবে। স্যার কি করবেন? তোমাকে মারধোর করবেন? ভদ্রলোকরা কখনো মারধোর করেন না। বকাঝকা হয়ত করবেন। বকাঝকায় কি যায় আসে? তুমি এসো তো আমার সঙ্গে।
তাহের যন্ত্রের মত উঠে দাঁড়াল। পারুল দোতলার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বলল, আমার ভাল কোন শাড়ি নেই। ভাল শাড়ি থাকলে সুন্দর করে সাজতাম। তাহের বলল, হুঁ। পারুল বলল, তুমি শুকনো গলায় বললে, হুঁ। পৃথিবীর অন্য যে কোন স্বামী হলে কি করত জান? বলত–না সাজলেও তোমাকে পরীর মত লাগে।
তাহের বিড় বিড় করে বলল, কাৰ্জিটা ঠিক হচ্ছে না পারুল, অন্যায় হচ্ছে।
অন্যায় হলে হোক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো আমাদের অন্যায় করতে বলে গেছেন।
অন্যায় করতে বলেছেন!
অবশ্যই বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন–ন্যায় অন্যায় জানিনে জানিনে, শুধু তোমারে জানি।
পারুল মাস্টার বেডরুমের দরজা খুলে বাতি জ্বালাল–বিশাল রুম, চারদিক আলোয় আলোয় ঝলমল করে উঠল। পারুল বলল, দেখলে কত সুন্দর।
তাহের হতভম্ব চোখে তাকিয়ে আছে। তার চোখে পলক পড়ছে না। বিশাল ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা খাট। ঘরের মেঝে ধবধবে শাদা। খাটটা কুচকুচে কালো রঙের। মনে হচ্ছে–শাদা মেঘের উপর কালো গোলাপ ফুটে আছে। খাটের দুপাশের সাইড টেবিলে দুটি টেবিল ল্যাম্প। স্বচ্ছ শাদা কাচের টেবিল ল্যাম্প। ঘরে আর কোন আসবাব নেই। চারপাশের দেয়ালে সুন্দর সুন্দর পেইন্টিং। পারুল বলল, মাস্টার বেডরুমের সঙ্গের বাথরুমটা কত সুন্দর দেখতে চাও?
না।
মাস্টার বেডরুমের সঙ্গের বারান্দাটায় একটু অস। আমার ধারণা, ঐ বারান্দা পৃথিবীর সবচে সুন্দর বারান্দা। এসো, বারান্দায় একটু দাঁড়াই।
না।
কথায় কথায় না বলবে না। এসো।
পারুল তাহেরের হাত ধরে প্রায় টেনে বারান্দায় নিয়ে গেলে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আতংকে তাহের প্রায় জমে গেল। কারণ লনে কামরুল দাঁড়িয়ে আছে। সে তাকিয়ে আছে তাদের দিকেই। কামরুলের পাশে তিনটা কুকুর। এরাও কৌতূহলী চোখে দেখছে। চাঁদের আলোয় কুকুর তিনটার চোখ জ্বল জ্বল করছে। মনে হচ্ছে ছটি আগুনের ফুলকি।
পারুল খিলখিল করে হাসছে। তাহের বিরক্ত গলায় বলল, হাসছ কেন? পারুল হাসতে হাসতে বলল, কুকুরের সর্দার কি রকম অবাক হচ্ছে এই ভেবে হাসছি। তুমিও একটু হাস তো। দুজনে মিলে হাসলে ও পুরোপুরি ভড়কে মাবে। হি হি হি।
এক কেজি টক দৈ
তাহের এক কেজি টক দৈ কিনেছে। পঁয়তাল্লিশ টাকা বের হয়ে গেছে। বুকের ভেতর খচখচ করছে। দৈ না কিনলেও হত। মিষ্টির দোকানের সামনে সিগারেট কিনতে না দাঁড়ালে হয়ত দৈ কেনা হত না। ম্যানিব্যাগে নতুন ৫০ টাকার নোটটা থাকত। এখন আছে একুশ টাকা।
দৈ কেনা হয়েছে সিরাজউদ্দিন সাহেবের জন্যে। তাহের ঠিক করেছে মতিঝিল যাবার পথে তার বাড়ি হয়ে যাবে। সম্পর্কটা ঝালিয়ে রেখে যাবে। কে জানে পারুলকে নিয়ে এই বাড়িতেই হয়ত উঠতে হবে। নীলা হাউস ছেড়ে তাদের যদি চলে আসতে হয় তাহলে যাবে কোথায়? যাবার একটা জায়গা তো লাগবে। নানান রকম সম্ভাবনা নিয়ে তাহের চিন্তাভাবনা করছে। তার একটা হল–মেসবাউল করিম সাহেবের কাছে সমস্যার কথাটা বলা। তাঁর এত বড় বাড়ি–তার এক কোণায় সে পারুলকে নিয়ে কবে। কিছু বোঝাই যাবে না। সিন্ধুতে বিন্দু। এতে তারও লাভ হবে। দুজনে মিলে ঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখবে। তিনি এই প্রস্তাবে রাজি না হলে তাহের তার চাকরির কথাটা তুলবে। তাহেরকে একটা ভদ্র চাকরি জোগাড় করে দেয়া তার কাছে কিছুই না। টেলিফোন তুলে দুটা কথা বললেই চাকরি হবে। তবে ক্ষমতাবান লোকদের সমস্যা হল তারা সহজে টেলিফোন তুলতে চান না।
তাহের সিরাজউদ্দিন সাহেবের বাড়িতে ঢুকে হকচকিয়ে গেল। বাড়ি ভর্তি মানুষ। এক তলায় প্যান্ডেলের মত করা হয়েছে। হৈচৈ-এ কান পাতা যাচ্ছে না। ভিডিও ক্যামেরা কাঁধে এক ছেলে ঘুরছে। তার সাথে একজন লাইটম্যান।
সিরাজউদ্দিন সাহেব ইস্ত্রী করা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে বসার ঘরে ইজিচেয়ারে কাত হয়ে আছেন। তাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে–চুল কেটেছেন কিংবা চশমার ফ্রেম বদলেছেন। তাহেরকে দেখে তিনি আনন্দিত গলায় বললেন, আসুন আসুন। আপনি দেরি করে ফেলেছেন।