শুনে ফেললে কি করবে? আমাকে মারবে?
আহা, কি দরকার।
তাহের শুধু লুচি ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। খাওয়া দেখেই মনে হচ্ছে সে খুব ক্ষুধার্ত।
শুধু শুধু লুচি খাচ্ছ কেন? চিনি দেই? চিনি দিয়ে খাও। দেব?
দাও।
চায়ের পানি চাপাতে চাপাতে পারুল বলল, তোমার মন-টন খারাপ কেন? কোন দুঃসংবাদ আছে?
হুঁ।
দুঃসংবাদটা কি?
করিম সাহেব পরশু আসছেন। কালকের মধ্যে তোমাকে চলে যেতে হবে।
পরশু এসেই তো তিনি এই বাড়িতে ছুটে আসবেন না। কাজেই তোমার এত চিন্তিত হবার কিছু নেই। এখনো আমাদের হাতে কয়েক দিন সময় আছে। তাছাড়া আমার মনে হয় না তিনি পরশুই আসবেন। আমরা অনেকদিন থাকতে পারব। অহনা না আসা পর্যন্ত আমাদের নাড়তে হবে না।
অহনা কে?
অহনা হচ্ছে আমাদের মেয়ের নাম।
তোমার কথাবার্তা তো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
বুঝতে না পারার মত জটিল করে তো কিছু বলছি না। আমার ধারণা এই বাড়িতে আমরা অনেক দিন থাকতে পারব। আমার ইনট্যুইশন তাই বলছে।
ম্যানেজার সাহেবের কাছে ফ্যাক্স এসেছে, পরশু সন্ধ্যা সাতটা তিরিশ মিনিটে বৃটিশ এয়ারওয়েজে আসছেন।
আসলে আসুক। তোমার এত চিন্তিত হবার কিছু নেই।
তোমাকে নিয়ে তুলব কোথায়?
কোথাও তুলতে হবে না–আমি এই বাড়িরই কোন এক ফাঁক-ফোকরে লুকিয়ে থাকব। খাটের নিচে কিংবা আলমারির ভেতর…হি হি হি।
তাহের বিষণ্ণ মুখে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। পারুলের সঙ্গে তর্কে-বিতকে যাওয়া অর্থহীন। বলুক তার যা ইচ্ছা। যে মেয়ে নিজের সমস্যা বুঝে না, হি হি করে হাসে, তাকে তো জোর করে কিছু বুঝানো যাবে না। পারুল বলল, আরেক কাপ চা দেব?
তাহের বিরক্ত গলায় বলল, এই তো খেলাম এক কাপ। আরেক কাপ কেন?
প্রথম কাপটা তাড়াহুড়া করে খেয়েছ। দ্বিতীয় কাশটা আরাম করে খাও। আমি করে চা খেতে খেতে হাসিমুখে কিছুক্ষণ আমার সঙ্গে গল্প কর।
তাহের তাকিয়ে আছে–পারুল মিটিমিটি হাসতে হাসতে বলল, এত চিন্তা করে তো কিছু হবে না। আমরা বাস করি বর্তমানে। আমরা বর্তমানটাই দেখব। ভবিষ্যতে কি হবে বা না হবে তা নিয়ে মাথা ঘামাব না। বর্তমানে আমি কোন সমস্যা দেখছি না। অন্তত আগামী পরশু পর্যন্ত আমাদের কোন সমস্যা নেই। বানাব চা?
বানাও।
চায়ের কাপে চিনি ঢালতে ঢালতে পারুল বলল, একটা মজা দেখবে?
কি মজা?
দেখবে কি না বল।
তাহের মজা দেখবে কি না সে বিষয়ে পুরোপুরি সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। মজা দেখাতে গিয়ে পারুল কি করে কে জানে। উদ্ভট কিছু করে বসবে, বলাই বাহুল্য। তখন মজা আর মজা থাকবে না।
কি, কথা বলছ না কেন? দেখবে?
হুঁ।
পারুল তাহেরের হাতে চায়ের কাপ দিয়ে রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসল। হেসেই ঠোঁট সরু করে ডাকল–মিকি, নিকি, কিবো।
তৎক্ষণাৎ তিনটি গ্রে হাউন্ড ছুটে এসে গ্রীলের ভেতর দিয়ে তাদের সরু মুখ বের করে দিল। তাহের এমন আঁতকে উঠল যে, তার চায়ের কাপ থেকে চা ছলকে গায়ে পড়ে গেল।
পারুল হাত বাড়িয়ে কুকুরগুলির গলায় হাত বুলাচ্ছে। তারা প্রবল বেগে লেজ নাড়ছে। তাহেরের বিস্ময়ের কোন সীমা রইল না। পারুল খুশি খুশি গলায় বলল, এদের আমি পুরোপুরি কনট্রোলে নিয়ে এসেছি। ইচ্ছা করলে তুমি এখন অমিকে কুকুরের দারুনী ডাকতে পার।
তাহের ক্ষীণ স্বরে বলল, এদের বশ করলে কি করে?
আমাকে কিছু করতে হয়নি, ওরা নিজে নিজেই বশ হয়েছে। নিম্নস্তরের বুদ্ধিবৃত্তির প্রাণীদের বশ করতে আমার নিজের কিছু করতে হয় না। তোমাকে বশ করতে কি আমার কিছু করতে হয়েছে?
তাহের তাকিয়ে আছে। পারুল বলল, আমার কথায় রাগ করনি তো?
রাগ করব কেন?
তোমাকে নিম্নস্তরের বুদ্ধিবৃত্তির প্রাণী বললাম এই জন্যে…
তোমার অদ্ভুত অদ্ভুত কথায় আমি অভ্যস্ত। অভ্যস্ত না হলে রাগ করতাম। তবে কুকুরের সঙ্গে তুলনা দেয়াটা ঠিক হয়নি। এটা অভদ্রতা।
সরি।
থাক, সরি বলতে হবে না। ওদের বিদেয় কর। বিদেয় করে সাবান দিয়ে হাত ধোও। ভাল করে ধুবে। কুকুর নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি আমার পছন্দ না।
আমারও পছন্দ না। বাধ্য হয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছি।
বাধ্য হয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করচ্ছ মানে?
পারুল চাপা গলায় বলল, এই কুকুরগুলি নিয়ে আমার একটা পরিকল্পনা আছে।
কি পরিকল্পনা?
এখন কিছুই বলব না। যথাসময়ে জানবে।
পারুল কুকুরের গা থেকে হাত সরিয়ে নিয়েছে। ওরা চলে যাচ্ছে না। আগে জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে।
কামরুল দূর থেকে কয়েকবার ডাকল, কাম অন, কাম অন। ওরা নড়ল না। তারা তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পারুলের দিকে। তাহেরও তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টিতে গভীর বিস্ময়।
ঘুমুতে যাবার আগে দিনের শেষ সিগারেট ধরালো তাহেরের অনেক দিনের অভ্যাস। সিগারেট শেষ করে সে এক গ্লাস পানি খাবে। পানি খাবার পর পর বিশ্রী ভঙ্গিতে কয়েকবার হাই তুলে বিছানায় যাবে এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘুম। অভাবী মানুষেরা চট করে ঘুমুতে পারে না। বিছানায় শুয়ে অনেকক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে। তাহেরের সেই সমস্যা নেই।
তাহের দিনের শেষ সিগারেট ধরিয়েছে, তবে তেমন মজা পাচ্ছে না। ঠিক তার সামনেই পারুল বসে আছে। পারুল তাকিয়ে আছে তার দিকে। চোখ দেখে মনে হচ্ছে কিছু বলবে। কিন্তু কিছু বলছে না। যতবারই পারুলের দিকে চোখ যাচ্ছে ততবারই তাহের অস্বস্তিতে নড়ে চড়ে উঠছে।
কিছু বলবে পারুল?
পারুল না-সূচক মাথা নাড়ল। মাথার সঙ্গে সঙ্গে হাতও নাড়ল। হাতের কাচের চুড়ি ঝনঝন করে শব্দ করল। তাহের চমকে উঠল শব্দ শুনে, যদিও চমকানোর কোন কারণ নেই। তাহের সিগারেট শেষ করে বলল, পানি দাও।