তাহেরের দুপুরের আগেই চলে আসার কথা। সে ফিরলে দুজন এক সঙ্গে খেতে বসবে। খাবার সময় গল্পগুজব করে খেতে পারুলের ভাল লাগে। তাহের অবশ্যি নিঃশব্দে খায়। প্লেট থেকে চোখ পর্যন্ত তুলে না। কথা না বলার পারুল একাই বলে। কথা বলার জন্যেও তো কাউকে দরকার।
দুপুর গড়িয়ে গেল, তাহের এল না। একা একা ভাত নিয়ে বসতে পারুলের ইচ্ছা করছে না। যদিও সময় মত তার খেতে বসা দরকার। তার নিজের জন্যে না, যে শিশুটি তার শরীরে বড় হচ্ছে তার জন্যে।
পারুল বিছানায় শুয়ে আছে। খিদে ভালই লেগেছিল–এখন খিদে মরে যাচ্ছে। জানালা দিয়ে আসা রোদের দিকে তাকিয়ে বোঝা যাচ্ছে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলেই বকেল হয়ে যাবে। বিকেলে তাহের যদি ফিরে তখন কি করবে? অবেলায় খাবে? না কি কয়েকটা লুচি ভেজে দেবে? তাহের লুচি খুব পছন্দ করে। ঘরে ময়দা আছে, ডালডা আছে। লুচির জন্যে ময়দা ছেনে রাখা উচিত–পারুলের বিছানা ছেড়ে নামতে ইচ্ছা করছে না। ক্লান্ত লাগছে। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে।
একা একা শুয়ে থাকতে ভাল লাগে না। কথা বলার জন্যে একজন কেউ যদি থাকত, কোন প্রিয় বান্ধবী। পারুল মনে মনে তার শিশুটির সঙ্গেই কথা বলা শুরু করল।
কিরে, তুই কি করছিস? তোর কি খিদে লেগেছে। আমার খিদে লাগলে কি তোরও খিদে লাগে? না কি আমার খিদের সঙ্গে তোর খিদের সম্পর্ক নেই? আমি তোর বাবার জন্যে অপেক্ষা করছি। সে এলেই খেতে বসব।
আচ্ছা বড় হয়ে তুই কাকে বেশি পছন্দ করবি? আমাকে, না তোর বাবাকে? আমার মনে হয় তোর বাবাকেই তুই বেশি পছন্দ করবি। বোকা হলেও মানটা পছন্দ কবার মত। বাবাকে বোকা বলায় রাগ করিসনি তো? মে বোকা তাকে তো আর জোর করে বুদ্ধিমান বলা যায় না। বলা উচিত না।
যত দিন যাচ্ছে তোর বাবার বোকা ভাব ততই বাড়ছে। কেন বল তো? অভাবের কারণে। তুই দেখবি বোকা লোক বেশির ভাগই অভাবী। বোকার সঙ্গে টাকাপয়সার একটা সম্পর্ক আছে। হঠাৎ কোন কারণে আমরা যদি কোটি কোটি টাকা পেয়ে যাই তখন দেখবি তোর বাবাকে আর বোকা বোকা লাগছে না, বরং বেশ বুদ্ধিমান মনে হবে।
না না শোন, তোর বাবা কিন্তু বোকা না। ও চুপচাপ থাকে। নিজের মত করে ভাবে বলে একে বোকা লাগে।
আচ্ছা, তুই ছেলে না মেয়ে বল তো? আমার ধারণা, মেয়ে। এবং আমার ধারণা তুই অসম্ভব বুদ্ধিমতী হবি। মেয়েদের বেশি বুদ্ধি না হওয়াই ভাল। মেয়েদের বেশি বুদ্ধি হলে পদে পদে সমস্যা। বুদ্ধিমতী মেয়ে কখনোই জীবনে সুখী হয় না। কেন হয় না? এখন না, তুই বড় হ, তখন তোকে বুঝিয়ে দেব। অবশ্যি ততদিন যদি আমি টিকে থাকি তবেই। আমার মন বলছে, তোকে জন্ম দিতে গিয়েই আমি মারা যাব। আমার আবার এক ধরনের ক্ষমতা আছে। আমি আগে ভাগে সব কিছু বুঝতে পারি। আমার মনে হচ্ছে, তোর জন্ম হবে এই বাড়িতে। কেন এ রকম মনে হচ্ছে তা বলতে পারছি না। মনে হবার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। মেসবাউল করিম সাহেব, যার এই বাড়ি, তিনি যে কোনদিন চলে আসবেন। তোর বাবা গেছে কবে আসবেন তাই জানতে। তিনি এলেই আমাদের এ বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। তখন আমরা কোথায় যাব কিছুই জানি না। আমাদের যাবার জায়গা নেই, বুঝলি? ঘর নেই, বাড়ি নেই, তোর বাবার চাকরি নেই–কিছুই নেই। থাক, এসব নিয়ে তোকে চিন্তা করতে হবে না। তুই থাক তোর মত। গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাক আমার পেটে। তোর ঘরটা তো খুব সুন্দর। এয়ার কন্ডিশান্ড ঘর। এই ঘরের তাপ বাড়ে না, কমেও না। তোর বিছানাও তো খুব মজার। পানির ওপর ভাসছে–এমন বিছনা। মেসবাউল করিম সাহেবের ওয়াটার বেডের চেয়েও ভাল।
পারুল মুমিয়ে পড়ল। তার ঘুম ভাঙল সন্ধ্যায়। ঘরের ভেতর কেমন ছমছমে অন্ধকার। জানালা দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে–শরীরে কাঁপন লাগছে। পারুল ঘর ছেড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল, দেখল–গেটের ফোকর দিয়ে তাহের ঢুকছে। অন্ধকার পরিষ্কার কিছু দেখা যাচ্ছে না, তবু তাহেরের মুখটা মনে হচ্ছে ভয়ে ও আতংকে এতটুকু হয়ে আছে। গেটের পাশে কামরুল দাঁড়িয়ে। তাহের তাকে ফিস ফিস করে কি বলল। কামরুল মাথা নাড়ছে। কুকুর তিনটা কোথায়? এদের কি চেইন দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়েছে। তাহের ক্লান্ত পায়ে এগুচ্ছে। তার হাতে পলিথিনের একটা প্যাকেট। পারুল দরজা খুলে দাঁড়াল।
পারুল বলল এত দেরি করলে যে?
তাহের ফ্যাকাসে ভঙ্গিতে হাসল।
দুপুরে কিছু খেয়েছ?
একটা সিঙ্গারা খেয়েছি।
শুধু সিঙ্গারা?
একটা সিঙ্গারা আর এক কাপ চা।
এখন কিছু খাবে? লুচি ভেজে দেব? লছি আর ডিম।
দাও, খুব খিদে লেগেছে।
হাত-মুখ ধুয়ে আস–লুচি ভেজে দিচ্ছি। এত দেরি হল কেন?
তাহের কিছু বলল না। হাত-মুখ ধুতে গেল। পারুল লুচি বেলতে বসল। তাহেরের মস্যাটা সে ধরতে পারছে না। খুব বড় কোন সমস্যা না। যারা সারাক্ষণ সমস্যার ভতর বাস করে তাদের ভেতর এক সময় না এক সময় এক ধরনের নির্বিকার ভঙ্গি চলে আসে। তাহেরের ভেতরও এসেছে। তাকে সব সময় মোটামুটি নির্বিকারই মনে হয়। তবে আজ তাকে কেমন যেন চিন্তিত মনে হচ্ছে।
লুচির সঙ্গে ডিম ভেজে দেয়া গেল না। একটাই ডিম ছিল, সেটা পচা বেরুল। পারুল বলল, কুকুরের সর্দারকে বল না চট করে দোকান থেকে একটা ডিম নিয়ে আসুক। ওকে টাকা দিয়ে দাও।
তাহের বিস্মিত হয়ে বলল, কুকুরের সর্দার আবার কে?
কামরুল নামের লোকটা।
ওকে ডিম আনতে বললে ও শুনবে কেন? উল্টা ধমকধামক দেবে। আর শোন, কুকুরের সর্দার-ফর্দার এইসব বলার দরকার নেই—শুনে-টুনে ফেলবে।