কামরুল আবার থুথু ফেলল এবং আবারও থুথুর খানিকটা ঠোঁটের কাছে ঝুলে রইল। পারুলের মনে হল লোকটার জিব খানিকটা বাঁকা এই জন্যে থুথু সরাসরি ফেলতে পারে না, বাঁকা করে ফেলে, বাঁকা করে ফেলার জন্যে খানিকটা ঠোঁটের কোণায় লেগে থাকে।
কামরুল চলে যাচ্ছে। আগের জায়গায় গিয়ে চামড়ার বলটা হাতে নিয়ে বলল, কাম অন বেবী। কাম অন। প্লে টাইম।
কুকুর তিনটা নড়ল না। গ্রিলের পাশে দাঁড়িয়ে রইল। পারুল ফিস ফিস করে বলল, তোরা নড়িস না, দাঁড়িয়ে থাক। তোরা দাঁড়িয়ে থাকলে লোকটার একটা উচিত শিক্ষা হবে। তুই বলায় আবার রাগ করছিস না তো? তোদের সর্দার আমাকে তুমি বলায় আমি রাগ করিনি। কাজেই তোদেরও রাগ করা উচিত না।
পারুলের এই কথায় ফিবো খুব লেজ নাড়তে লাগল। ফিবোর দেখাদেখি অন্য দুজনও লেজ নাড়া শুরু করল। ব্যাপারটা স্নায়ুযুদ্ধের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। একদিকে কুকুরের সর্দার, অন্যদিকে সে, মাঝখানে তিনটা ভয়াবহ দর্শন গ্রে হাউন্ড।
পারুল বলল, কিরে, তোরা কিছু খাবি? চাল খাবি, চাল?
কুকুর কি চাল খায়? গরু ভেড়া এরা খায়। মুঠি ভর্তি চাল ধরলে খুব আগ্রহ করে খায়। পারুল কুকুরকে কখনো চাল খেতে দেখেনি তবে ভাত খেতে দেখেছে। চাল আর ভাতে তফাৎ তো তেমন নেই। দেবে না কি খানিকটা চাল?
কামরুল আবার ডাকল–কাম অন। কাম অন।
এরা তিনজন নড়ল না। পারুল মুঠি ভর্তি চাল এদের সামনে ধরল। তিনজনই একসঙ্গে চাল শুঁকে আবার আগের অবস্থায় ফিরে গেল। মনে হচ্ছে এরা চাল খায় না।
কিরে ভাত খাবি? ভাত খেলে অপেক্ষা করতে হবে। এখন গোশত রান্না হচ্ছে। ও কোত্থেকে হাফ কেজি গরুর গোশত নিয়ে এসেছে। খুবই এক্সপেরিয়েন্সড বুড়ো গরুর গোশত বলে সিদ্ধ হচ্ছে না। গোশত নেমে গেলেই ভাত চড়াব। তখন তোদের গরম গরম খেতে দেব।
মাইক ঘরঘর ধরনের শব্দ করল। কুকুরের ভাষায় কিছু বলল। পারুলের ধারণা, মাইক বলল, আপনাকে ধন্যবাদ। আমরা অপেক্ষা করছি। রান্না হোক, তারপর গরম গরম খাব।
আধা সেদ্ধ গোশত খানিকটা খাবি না কি? খেতে চাইলে তিনজনকে তিন টুকরা দিতে পারি। তোদের সর্দার আবার রাগ না করলে হয়। কি বিশ্রী করে সে তাকাচ্ছে। তোদের সঙ্গে গল্প করছি তো, ওর সহ্য হচ্ছে না।
পারুল তিন টুকরা গোশত বের করল। পানিতে ডুবিয়ে ঠাণ্ডা করল। মেঝেতে ফেলে দিলে ওরা হয়ত খাবে না। সাহেব কুকুর–এদের খাবার দিতে হবে প্লেটে করে, আদবের সঙ্গে। পলি গোশত হাতে করেই ওদের সামনে ধরল। একজনের জন্য এক টুকরা। সবার প্রথম মাইক। মাইকের সামনে ধরতেই সে একটু পিছিয়ে গেল। পারুল বলল, কিরে খাবি না? না কি এখন তোদের লাঞ্চ টাইম না? মাইক এগিয়ে এল। গোশতের টুকরা মুখে নিয়ে নিল। নিকি এবং ফিবো কোন আপত্তি করল না।
কামরুল আসছে। তার মুখ থমথম করছে। রাগের কারণেই কুঁজো হয়ে গেছে। বেশি রেগে গেলে মানুষ সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। খানিকটা কুঁজো হয়ে পড়ে।
তুমি এরারে কি খাওয়াইতেছ?
গরুর গোশত। বী।
তুমি পাইছ কি? এরর খাওয়ার নিয়ম আছে, তুমি জান না?
না জানি না। আমি তো আর কুকুরের সর্দার না।
তুমি এই বাড়িতে থাকতে পারবা না।
সে তো আর বলে দিতে হবে না। আমি জানি থাকতে পারব না। বাড়ি তো আর আমার না।
আইজ দিনে দিনে বিদায় হইবা।
পারুল অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, রাণে মানুষটা কাঁপছে। থর থর করে কাঁপছে, মুখে ফেনা জমে গেছে–একটা মানুষ এত দ্রুত এতটা রাগতে পারে?
তোমার কত বড় সাহস। কুকুর নষ্ট কর। দাম জান? এই কুকুরগুলার দাম জান?
না, দাম জানি না। শুধু মরা হাতির দাম জানি। মরা হাতির দাম হচ্ছে লাখ টাকা। মরা কুকুরের দাম কত?
চুপ, চুপ। চুপ বললাম…
পারুল লক্ষ্য করল লোকটা আরো কিছু কঠিন কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ নিজেকে সামলাল। মুহূর্তের মধ্যে তার চেহারা পাল্টে গেল। তার রাগী মুখ মুহূর্তের মধ্যে হয়ে গেল ভীত সংকুচিত একজন মানুষের মুখ। এখনো সে কাঁপছে তবে রাগে নয়, আতংকে। হঠাৎ লোকটা এত ভয় পেল কেন?
কারণটা পারুলের কাছে স্পষ্ট হল। সে অবাক হয়ে দেখল, তিনটি কুকুরই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কামরুলের দিকে। তাদের শরীর স্থির হয়ে আছে। তিনজনেরই লেজ নামানো এবং তিনজনেই এক ধরনের গম্ভীর শব্দ করছে। কামরুল নামের মানুষটা আতংকে শাদা হয়ে গেছে কুকুরের এই মূর্তি দেখে। সে এদের জানে। জানে বলেই ভয় পাচ্ছে। পারুল ভেবে পেল না, সামান্য তিন টুকরা মাংস দিয়ে সে কি কুকুরগুলির কর্তৃত্ব তার হাতে নিয়ে নিয়েছে্রর? তাকে অপমান করা হচ্ছে এটা বুঝতে পেরে কুকুর তিনটা রুদ্র মূর্তি ধরেছে। আশ্চর্য তো!
কামরুল অস্পষ্ট গলায় কি বলতে গিয়েও থেমে গেল। কয়েক পা পিছিয়ে গেল। তার ভয় দেখে পারুলেরই এখন মায়া লাগছে। সে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্যে সহজ গলায় কুকুরদের ডাকল–ফিবো, নিকি, মাইক। তিনজন চট করে ফিরল তার দিকে। পারুল হাসল। কুকুররা কি হাসি বুঝতে পারে?
তোরা মানুষদের ভয় দেখাস কেন? যে তোদের এত দিন আদর-যত্ন করে বড় করল তাকেই ভয় দেখাচ্ছিস–এটা কোন কাজের কথা হল? দেখি গলাটা আরেকটু লম্বা কর–আদর করে দি।
পারুল রেলিঙের ভেতর দিয়ে হাত চালিয়ে ফিবোর গায়ে রাখল। না, পারুলের মোটেই ভয় লাগছে না। এদের খুব আপন লাগছে। আদর করা হচ্ছে একজনকে কিন্তু তিনজনই প্রবল বেগে লেজ নাড়ছে। কামরুল দূরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে। তার চোঙ্গভতি বিস্ময়।