তাহের কদমবুসি করার জন্যে নিচু হতেই তিনি বললেন, পায়ে হাত দিও না। পায়ে হাত দিলে ব্যথা লাগে।
পারুল রান্না বসিয়েছে
পারুল রান্না বসিয়েছে। যেহেতু সে স্টোভে রান্না করে তার রান্নাঘর চলমান। একেক সময় একেক জায়গায় থাকে। এখন সে রান্না করছে বারান্দায়। খোলামেলা বারান্দা, একদিকে গ্রীল দেয়া। বাতাস আসছে–স্টোভের আগুন ছড়িয়ে যাচ্ছে। রান্না হতে দেরি হবে। হোক। তার এমন কোন কাজকার্য নেই। সারাদিনে একবেলা রান্না। রান্নাটা তাড়াতাড়ি হয়ে গেলেই বরং তার সমস্যা–বাকি সময় কাটবে কিভাবে?
তাহের সকাল বেলা ঢাকা চলে গেছে। মেসবাউল করিম সাহেবের অফিসে যাবে। তিনি ঠিক কবে আসবেন, কোন প্লেনে আসবেন জেনে আসবে। তাঁর ঢাকা এসে উপস্থিত হবার আগেই পারুলকে বাড়ি ছেড়ে যেতে হবে।
এত বড় একটা বাড়িতে পারুল একা। বাড়ির বাইরে চারটি প্রাণী আছে–তিনটা এলসেসিয়ান কুকুর, একজন কুকুরের সর্দার। কুকুর তিনটার নাম আছে নিকি, মাইক, ফিবো। এর মধ্যে নিকি হল মেয়ে কুকুর। নিকির নাকে শাদা ফুটকি। মাইক এবং ফিবো দেখতে অবিকল এক রকম। কামরুল নামের কুকুরের সর্দার এদের আলাদা করে কি করে, সেই জানে। পারুলের ধারণা গন্ধ শুঁকে শুঁকে। কুকুরের সঙ্গে থেকে থেকে তারও নিশ্চয়ই ঘ্রাণশক্তি বেড়েছে।
রান্না করতে করতে পারুল দেখল, কুকুরের সর্দারটা এখন কুকুর তিনটাকে খেলা দিচ্ছে। ক্রিকেট বলের মত একটা চামড়ার বল ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে। দুটা কুকুর সেই বল নিয়ে খুব নাচানাচি করছে কিন্তু তিন নম্বর কুকুরটা করছে না। সে দূরে দাঁড়িয়ে আছে। যে দূরে দাঁড়িয়ে, তাকে বল খেলায় আকৃষ্ট করার অনেক চেষ্টা করা হচ্ছে, লাভ হচ্ছে না। আদুরে গলায় কামরুল বলছে–যাও নিকি, যাও। খেলটু কর, খেলটু।
নিকি খেলটু করার দিকে আগ্রহী নয়, বরং তাকে দেখে মনে হচ্ছে অন্য দুজনের ছেলেমানুষী খেলা দেখে নিকি বিরক্ত। সে খুব ধীর লয়ে লেজ নাড়ছে। কুকুর তার বেশিরভাগ কথাই নাকি লেজ মারফত বলে। সাইন ল্যাংগুয়েজ। ধীরে ধীরে লেজ নাড়ার অর্থ কি কুকুরের সর্দার জানে? পারুল মনে মনে একটা অর্থ করল–ধীর গতিতে লেজ নাড়ার অর্থ আমি বিরক্ত হচ্ছি, আমি খুব বিরক্ত হচ্ছি। পারুল নিজের অজান্তেই ডাকল–নিকি, এই নিকি।
নিকির লেজ নাড়ানো বন্ধ হয়ে গেল। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। অন্য দুজনও খেলা বন্ধ করে তাকালো। কুকুরের চোখের ভাষা পড়া যায় না। পড়া গেলেও এতদূর থেকে নিশ্চয়ই যায় না। পারুল বলল, এই নিকি, কাছে আয়।
বলমাত্র পারুলকে বিস্মিত করে নিকি ছুটে এল। গ্রীলের ফাঁক দিয়ে মুখ খানিকটা বের করে দিল। পারুলের ইচ্ছা হল–ও মাগো বলে বিকট একটা চিৎকার দেয়। নিজেকে সে চট করে সামলালো–যত ভয়ংকর কুকুরই হোক, গ্রীল ভেঙে নিশ্চয়ই আসতে পারবে না।
কিরে নিকি, তুই খেলাট করছিস না কেন? লেটু করতে ভাল লাগে না?
নিকি জবাব দিল না। মুখে তো কিছু বললই না, লেজ নেড়েও না। নিকির লেজ এখন স্থির হয়ে আছে। মাইক এবং ফিবো এসে দাঁড়াল নিকির কাছে। পারুলের মনে হল, অভিজাত কুকুরেরও আত্মসম্মানবোধ তেমন তীব্র না। এদের ডাকা হয়নি। তারপরেও এরা উপস্থিত হয়েছে।
পারুল বলল, তারপর তোদের খবর কি? তোর এমন ভয়ংকর চেহারা করে রেগেছিস কেন? ভয় দেখাতে ভাল লাগে?
ফিবি ও মাইক স্থির হয়ে আছে কিন্তু নিকি তার লেজ সামান্য নাড়ল। সাইন ল্যাংগুয়েজে এই সামান্য লেজ নাড়ার অর্থ কি?
কামরুল দূর থেকে ডাকল–কাম অন, কাম অন। নিকি, মাইক, ফিবো কাম অন প্লে টাইম। প্লে টাইম।
এরা ফিরেও তাকাল না। কামরুল বিরক্ত মুখে এগিয়ে আসছে। গ্রীলের কাছে এসে থু করে একদলা থুথু ফেলল। খুব সবটা পড়ল না, খানিকটা তার ঠোঁটের কাছে ঝুলে রইল। সে পারুলের দিকে তাকিয়ে চাপা সর্দি-বসা গলায় বলল, এদেরে ডাকলা কেন? কেন ডাকলা?
পারুল লোকটির দুঃসাহসে অবাক হয়ে গেল। দারোয়ান শ্রেণীর একটা মানুষ, কুকুরের সর্দার, অথচ কত অবলীলায় পারুলকে সে তুমি করে বলছে। যে পারুল এবার জিওগ্রাফীতে অনার্স পরীক্ষা দিয়েছে, উপরের দিকে সেকেন্ড ক্লাস থাকার কথা। ফোর্থ পেপারটা ভাল হলে সে ফাস্ট ক্লাসের স্বপ্ন দেখতে পারত। ফোর্থ পেপারটা একেবারে যাচ্ছেতাই হয়ে গেল। ক্র্যাশ করলেও করতে পারে। ক্র্যাশ করুক বা না করুক, ইউনিভার্সিটিতে পড়া একটা মেয়েকে কি অবলীলায় লোকটা তুমি ডাকল। এই সাহস তাকে কে দিয়েছে? কুকর তিনটা, না-কি তাহেরের কারণে সে তাকে তুমি বলছে? দারোয়ান-টাইপ একজন মানুষের স্ত্রী, তাকে তো তুমি বলাই যায়।
কামরুল বলল, খবর্দার, এদের ডাকাডাকি করব না।
পারুল খুব দ্রুত চিন্তা করল–লোকটাকে তুমি বলার জন্যে প্রথমেই কড়া একটা ধমক দেবে কি না। যাকে বলে ডাইরেক্ট কনফ্রন্টেশান। অবশ্যি অনেকের অভ্যাস থাকে সবাইকে তুমি বলার। লোকটা হয়ত মেসবাউল করিমকেও তুমি বলে। কুকুর নিয়ে যার কাজ তার বোধ, জ্ঞান কুকুরের কাছাকাছি থাকারই কথা। তাই যদি হয় তাহলে তুমি বলার জন্যে তার উপর রাগ করা যায় না। পারুল রাগ মুছে ফেলে প্রায় হাসিমুখে বলল, কুকুরকে ডাকা কি নিষেধ?
হ নিষেধ।
কুকুর তিনটার নাম আছে। নাম দেয়া হয় ডাকার জন্য। কাজেই আমার মনে হয়। এদের ডাকা নিষেধ না।
তুমি তোমার কাজ করা, কুকুর ডাকাডাকি করবা না।