গাদা গাদা গয়না না চাচী–গলার একটা চন্দ্রহার।
ওরে বাপরে, হারের নামও জান–চন্দ্রহার?
মার একটা স্মৃতিচিহ্ন। দিয়ে দিন না চাচী।
তুমি কি বলতে চাচ্ছি–তোমার মায়ের গয়না আমরা চুরি করেছি? আমরা চোর? এতদিন খাইয়ে পরিয়ে এই জুটল কপালে! চোর বানালে আমাদের? তুমি যেও না বস, তোমার চাচা আসুক অফিস থেকে। তারপর ফয়সালা হবে।
পারুল বসেনি, চাচার জন্য অপেক্ষা করে লাভ হত না। মার স্মৃতি রক্ষার জন্যে পারুল যে খুব ব্যস্ত ছিল তাও না। গয়নাটা পেলে তার লাভ হত–চার ভরি ওজনের হার। খাদ কেটেও সাড়ে তিন ভরির দাম পাওয়া যেত… টাকাটা কাজে লাগত।
তাহের বৌকে দিয়ে তার মার এক দূর সম্পর্কের এক ভাইয়ের বাসায় গেল। তিনি দীর্ঘ সময় চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকলেন। এক সময় চোখ স্বাভাবিক করে বললেন, তোমাকে তো চিনতে পারলাম না। তাহের তার নাম, তার মায়ের নাম, গ্রামের নাম সব বলল। ভদ্রলোক বললেন, ও আচ্ছা আচ্ছা। বলার ভঙ্গি থেকে মনে হল এখনো চিনতে পারেননি।
তাহের বিড় বিড় করে বলল, মামা, কয়েকটা দিন আমি আপনার বাড়িতে। থাকব। বিপদে পড়ে গেছি–হঠাৎ বিয়ে হয়ে গেলক…
কয়েকটা দিন মানে কতদিন?
ধরেন দশ-পনেরো দিন। এর মধ্যে একটা কিছু ব্যবস্থা করে ফেলব।
ভদ্রলোক বললেন—ও।
এই ও-র মানে কি? থাকতে দিচ্ছেন, না দিচ্ছেন না তাহের ধরতে পারল না। তাহের রাস্তায় রিকশা দাঁড় করিয়ে রেখেছে। পলি দুটি স্যটকেস আর একটা বেতের ঝুড়ি নিয়ে রিকশায় চুপচাপ বসে আছে। তাকে অবশ্যি তেমন চিন্তিত মনে হচ্ছে না। তাহের বলল–মামা, আমি এমন বিপদে পড়েছি ..
ভদ্রলোক বললেন, বিপদে যে পড়েছ তা তো বুঝতেই পারছি। চিনি না জানি না, সম্পর্ক ধরে উপস্থিত হয়েছ..।
মামা, পারুলকে কি রিকশা থেকে নামতে বলব?
পারুলটা কে?
আমার স্ত্রী। রিকশা থেকে নামতে বলব?
বল।
তাহেরের সেই দূর সম্পর্কের মামার নাম সিরাজউদ্দিন। প্যারালিসিস হয়ে ঘরে পড়ে আছেন। ঢাকায় নিজের বাড়িতে থাকেন। ঢাকা শহরের সবচে নোংরা বাড়িটা তাঁর। বাড়ি নোংরা, আসবাবপত্র নোংরা, সবই নোংরা। বাড়ি প্রথম তৈরির সময় যে চুনকাম হয়েছিল, তারপর সম্ভবত আর চুনকাম হয়নি। দোতলা বাড়ির দোতলা এবং একতলার অর্ধেকটা ভাড়া দেয়। ভাড়ার টাকাতেই সম্ভবত সংসার চলে।
সিরাজউদ্দিন সাহেব তাহেরকে চিনতে না পারলেও তার থাকার জন্যে একটা কামরা ছেড়ে দিলেন। কামরার সামনে এক চিলতে বারান্দা আছে।বারান্দার টবে বকমভিলিয়া গাছে লাল লাল পাতা। বারান্দা আলো হয়ে আছে। এটাচড্ বাথরুম। বাড়ি নোংরা হলেও বাথরুমটা পরিচ্ছন্ন। সিরাজউদ্দিন সাহেব তার স্ত্রীকে ডেকে বলেছিলেন–আমার খালাতো বোনের ছেলে, নতুন বৌ নিয়ে এসেছে, দেখবে কোন অযত্ন যেন না হয় …।
তাদের বাসর হল সিরাজউদ্দিন সাহেবের বাসায়। এতটুকু একটা খাট, তার ওপর ময়লা খয়েরি রঙের একটা চাদর। দুটি বালিশ আছে। একটায় ওয়ার নেই। পারুল বলল, মাগো! এত ছোট বিছানা হয়। একজনও তো আরাম করে শুতে পারবে না।
তাহের বলল, তুমি বিছানায় ঘুমাও। আমি মেঝেতে চাদর পেতে শুয়ে থাকব। আমার কোন অসুবিধা হবে না। আমার অভ্যাস আছে।
পারল বলল, আজি আমাদের বাসর রাত। আমরা দুজন বুঝি দু জায়গায় শুয়ে থাকব? তুমি যাও তো, কয়েকটা জিনিস কিনে আন। একটা সুন্দর চাদর, দুটা বালিশের কভার, আর কয়েকটা গোলাপ ফুল। যদি পাও সাত আটটা বেলী ফুলের মালা।
তাহের ইতঃস্তত করছে। পারুল বলল, কিছু টাকা অকারণে রাত হলে। হোক না।
সামান্য জিনিস দিয়ে পারুল কি সুন্দর করেই না ঘরটা সাজাল। তাহেরের চোখ প্রায় ভিজে এল। পারুল বলল, আজ রাতে আমরা খুব আনন্দ করব। কষ্টে কষ্টে আমার জীবন কেটেছে তোমারও তাই। আজ রাতে যেন আমাদের মনে কোন কষ্ট না থাকে। বলতে বলতে পারুল চোখ মুছল। চোখ মুছতেই থাকল। কিছুতেই সে কান্না থামাতে পারছে না। তাহের তাকিয়ে আছে বিষণ্ণ চোখে। সে যে স্ত্রীকে সান্তনা দেবে সে সাহস তার হচ্ছে না। তার শুধুই মনে হচ্ছে, এত কাছে বসে থাকা মেয়েটি আসলে এ্ত কাছের না–অনেক দূরের কেউ। ধরা-ছোঁয়ার বাইরের একজন।
দিন সাতেক থাকার কথা বলে তাহের এ বাড়িতে উঠেছিল। ছ মাস পার করে দিল। সিরাজউদ্দিন এই ছ মাসে একবারও বলেননি–আর কত? এবার বিদেয় হও।
ভাল মানুষ পৃথিবীতে আছে। সিরাজউদ্দিন নামের রাগী-রাগী চেহারার এই মানুষটা না থাকলে কি ভয়াবহ অবস্থাই হত তাদের। লোকটা পুরোপুরি আবেগশূন্য। যখন তাহের তাদের বাড়িতে থাকতে গেল তখন তিনি যন্ত্রের মত মুখ করেছিলেন। দিন চলে আসে সেদিনও তেমন।
তাহের বলল, আপনার উপকার আমি জীবনে ভুলব না।
ভদ্রলোক বললেন, ও আচ্ছা।
আপনাকে আমরা অনেক যন্ত্রণা করেছি .দয়া করে ক্ষমা করে দেবেন।
আচ্ছা।
ভদ্রলোক জানতেও চাননি তাহেররা কোথায় যাচ্ছে। যে মানুষের কোন কৌতূহল নেই সেও জিজ্ঞেস করবে–তোমরা যাচ্ছ কোথায়? ভদ্রতা করে হলেও করবে। তিনি তাও করলেন না। হাই তুললেন। তাহের নিজ থেকে বলল–মামা, আমরা যাচ্ছি নীলা হাউসে–শহরের বাইরে এক ভদ্রলোক একটা বাড়ি বানিয়েছেন–ঐ বাড়ির দেখাশোনা…
আচ্ছা আচ্ছা।
ভদ্রলোক আবেগশূন্য হলেও তাহেরের চোখ ভিজে আসছে। সে ধরা গলায় বলল, যদি কোনদিন আপনার কোন কাজে আসতে পারি, বলবেন।
আচ্ছা আচ্ছা।
মাঝে মাঝে এসে আপনাকে দেখে যাব।
আচ্ছা আচ্ছা।