- বইয়ের নামঃ পারুল ও তিনটি কুকুর
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ কাকলী প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
টক-টক করে ঘড়ির শব্দ
কিছুক্ষণ আগেও টক-টক করে ঘড়ির শব্দ হচ্ছিল।
এখন সেই শব্দও শোনা যাচ্ছে না। পুরো বাড়িটা হঠাৎ করেই যেন শব্দহীন হয়ে গেল। এত বড় একটা বাড়িতে কত রকমের শব্দ হবার কথা–বাতাসের শব্দ, পর্দা নড়ার শব্দ, টিকটিকি ডেকে ওঠার শব্দ। এখন কিছু নেই। এই যে পারুল নিঃশ্বাস ফেলছে সেই নিঃশ্বাসের শব্দও সে নিজে শুনতে পাচ্ছে না। আজ যে এটা প্রথম হচ্ছে তাই না, আগেও কয়েকবার হয়েছে। কেন এ রকম হয়? না কি পারুলের কোন অসুখ করেছে? বিচিত্র কোন অসুখ, যাতে মানুষ কিছু সময়ের জন্যে বধির হয়ে যায়। তার পৃথিবী হয় শব্দশুন্য। পৃথিবীতে কত ধরনের অসুখ আছে–এ ধরনের অসুখ থাকতেও তো পারে।
রাত কটা বাজে? দুটা না তিনটা? সময় জানার উপায় নেই। পারুল যে কামরায় শুয়েছে সেখানে কোন ঘড়ি নেই। ঘড়ি দেখতে হলে পাশের কামরায় যেতে হবে। সেখানে মানুষের চেয়েও উঁচু একটা ঘড়ি আছে। গ্র্যান্ডফাদার ক্লক। সেই ঘড়ির। পেন্ডুলামই এতক্ষণ টক-টক করছিল। এখন করছে না, কিংবা হয়তো এখনো করছে, পারুল শুনতে পারছে না, কারণ তার বিচিত্র কোন অসুখ করেছে।
পারুল পাশ ফিরল। কান পেতে রাখল–পাশ ফেরার কারণে তোষকে কোন শব্দ হয় কি না। তাও হল না। কি আশ্চর্য কথা। সে ভয়ার্ত গলায় ডাকল, এই এই। শুনছ, এই।
তাহের সঙ্গে সঙ্গে বলল, উঁ।
এতে পারুলের ভয় কাটল। যে ভয় হঠাৎ আসে, সেই ভয় হঠাৎই কাটে। পারুল এখন পুরোপুরি নিশ্চিন্ত বোধ করছে। দেয়াল ঘড়ির টক-টক শব্দটাও এখন পাওয়া যাচ্ছে। না, টক-টক শব্দ না, শব্দটা হল টক টকাস, টক টকাস। পারুল তাহেরের গায়ে একটা হাত তুলে দিল। তাহের কিছু বলল না। কারণ তার ঘুম ভাঙেনি। পারুলের ডাক শুনে সে উ বলেছে ঠিকই, সেই কথা ঘুমের মধ্যে বলা। জেগে থাকলে তাহেরের গায়ে হাত রাখা যেত না। বিরক্ত হয়ে সে হাত সরিয়ে দিত। শরীবের সঙ্গে শরীর লাগিয়ে ঘুমুতে তার নাকি অসহ্য লাগে।
ঘামে তাহেরের গা ভেজা।
সে পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে শুয়েছে। ঘামে সেই পাঞ্জাবি ভিজে চপচপ করছে। অথচ গরম তেমন না। আজকের আবহাওয়া এম্নিতেই ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা, তার উপর সিলিং ফ্যান রছে ফুল স্পীডে। মশারি খাটানো হয়নি বলে ফ্যানের পুরো বাসটা গায়ে লাগছে। জানালা খোলা। খোলা জানালা দিয়ে ভাল হাওয়া আসছে। পারুলের বরং শীত শীত লাগছে। অথচ মানুষটা কেমন ঘামছে। ঘামে ভেজা একটা মানুষের শরীরে হাত রাখতে ভাল লাগে না। কিন্তু হাতটা সরিয়ে নিতেও পারুলের ইচ্ছা করছে না। তার মনে হচ্ছে হাত সরিয়ে নিলেই আবার আগের মত হবে। জগৎ আবারো শব্দহীন হয়ে যাবে। তারচে ঘামে ভেজা মানুষের গা ঘেঁসে থাকা অনেক ভাল। পারুল তাহেরের আরো কাছে এসে ডাকল, এই এই।
তাহের সঙ্গে সঙ্গে বলল, উঁ।
কেমন জানি ভয় ভয় লাগছে। বাতি জ্বালিয়ে রাখি?
আচ্ছা।
তুমি কি ঘুমের মধ্যে কথা বলছ না, জেগে আছ?
উঁ!
উঁ আবার কি? ঠিক করে বল, জেগে আছ?
আছি।
পারুল মনে মনে হাসল। পৃথিবীতে কত বিচিত্র স্বভাবের মানুষ থাকে। লোকটা ঘুমের মধ্যে কি স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই না কথা বলছে। তার স্বভাব-চরিত্র না জানা থাকলে অন্য যে কেউ ভাববে সে জেগে।
ঘুমন্ত মানুষের সঙ্গে কথা বলার অনেক মজা। পারুল তাহেরের সঙ্গে এই মজাটা মিই করে। এখনো করতে ইচ্ছা করছে। পারুল বলল, এই, ঠাণ্ডা পেপসি খাবে?
হুঁ।
আনব?
আন।
বরফ দিয়ে আনব না বরফ ছাড়া?
বরফ।
আচ্ছা বেশ, বরফ দিয়েই আনব। পেপসি খাবার পর কি খাবে? ইঁদুর মারা বিষ বে? র্যাটম?
হুঁ।
হুঁ না, মুখে বল। যদি খেতে চাও বল–খাব।
খাব।
পারুল খিলখিল করে খানিকক্ষণ হাসল। এই বাড়ির ছাদ অনেক উঁচু সে জন্যেই বোধহয় হাসির শব্দ অনেকক্ষণ ঘরে হলে থাকল। হাসা উচিত হয়নি। আসার কারণে। পারুলের ঘুম পুরোপুরি ভেঙে গেছে। এখন আর বিছানায় শুয়ে থেকেও কিছু হবে না। শুধু শুধু শুয়ে থেকেই বা কি হবে? সে খুব সাবধানে বিছানা থেকে নামল। এই ঘরের বাতি জ্বালানো যাবে না। কারণ বাতি চোখে পড়া মাত্র তাহের উঠে বসে বিরক্ত ভঙ্গিতে। বলবে–ব্যাপার কি? লাইট জ্বালাল কে?
পারুল পা টিপে টিপে পালের ঘরে যাচ্ছে। পাশের ঘরের গ্র্যান্ডফাদার ক্লকের সামনে বসে থাকতে তার মন্দ লাগে না। লম্বা পেন্ডুলামটা এমনভাবে দুলে মনে হয় ওটা কোন মন্ত্র না, জীবন্ত কিছু। হাত-পা দুলছে। এই ঘরে স্ট্যান্ড বসানো ছয় ফুট লম্বা একটা আয়নাও আছে। আয়নাটা পারুলের ভাল লাগে না। আয়নার সামনে দাঁড়ালে মনে হয় আয়নায় যাকে দেখা যাচ্ছে সে অন্য একটা মেয়ে। অচেনা কেউ। বুকের মধ্যে ধ্বক করে ওঠে। তাহেরকে সে বেশ কয়েকবার বলেছে, আচ্ছা, এই আয়নায় নিজেকে দেখে আমি চমকে উঠি কেন?
তাহের বলেছে– এত বড় আয়না দেখে তো তোমার অভ্যেস নেই। সারাজীবন দেখেছ ছোট ছোট আয়না। এখন হঠাৎ করে নিজের পুরো শরীর দেখে চমকাচ্ছ। তাছাড়া…
তাছাড়া কি?
তোমার চমকানো রোগ আছে। অকারণেই তমি চমকাও।
কে বলল অকারণে চমকাই?
ঐদিন নিজের ছায়া দেখে চমকে চিৎকার করে উঠলে না?
ছায়া দেখে চমকানোর অবশ্যি কারণ ছিল। এই বাড়ির বাতিগুলি এমন যে, বিশ্রী বিশ্রী ছায়া পড়ে। গতকাল রাতে তার একটা সরু ছায়া পড়েছিল দেয়ালে। লম্বাটে লাঠির মত ছায়া–সেই লাঠিতে আবার হাত আছে, পা আছে। যে কোন মানুষ এটা দেখলে ভয়ে চিৎকার দিত।