রূপা আমার দিকে তাকিয়ে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, আপনার চোখ কি ট্যারা হয়েছে?
আমি কিছু বললাম না। তাকিয়ে রইলাম।
মেয়েটি সফিকের কথায় মোটেও বিব্রত বোধ করছে না। আমার দিকে তাকিয়ে আছে অসঙ্কোচে। সে আমার দিকে তাকিয়ে হালকা গলায় বলল, আচ্ছা আপনি কি কবি?
আমি বললাম, না।
বাঁচালেন। কবি হলে খানিকটা সমস্যা হত।
বলেই সে আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। আগ্রহের কারণ, সে অপেক্ষা করছে আমি জিজ্ঞেস করব—কি সমস্যা? আমি তা করলাম না। রূপা বলল, কি সমস্যা জানেন? কবি হলেই পরের দিন আপনি আবার আসতেন, পকেটে থাকত কবিতা। সেই কবিতা আমাকে নিয়ে লেখা। আমাকে শান্তমুখে সেই কবিতা শুনতে হত। এবং আবেগজর্জরিত কবিকে সমুচা খাওয়াতে হত। আপনি কি সমুচা খেয়েছেন?
হুঁ।
এ কেমন লাগল?
আমি জবাব দিলাম না। রূপা বলল, সফিক সাহেবের মতে সমুচাগুলি রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের মতো। আমি রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প পড়িনি, কাজেই বলতে পারছি না ব্যাপারটা কি? আপনি কি পড়েছেন?
একটা পড়েছি।
একটা পড়েছি।
শুধুই একটা?
শুধুই একটা?
হুঁ, হৈমন্তী।
পাঠ্য ছিল।
সফিক সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, মজার ব্যাপার কি জান? হৈমন্তী গল্পটা রঞ্জুর মুখস্থ। দাড়ি সেমিকোলনসহ।
সত্যি!
হ্যাঁ, সত্যি। তার যখন কিছু পছন্দ হয় সে মুখস্থ করে ফেলে। সে রবীন্দ্রনাথের একটা গল্প পড়েছে, কিন্তু সেটা তার মুখস্থ।
আমার বিশ্বাস হচ্ছে না–সত্যি?
আমি জবাব দিলাম না। সফিককে বললাম, চল উঠি।
রূপা আন্তরিক ভঙ্গিতে বলল, এখনই উঠবেন কি। বসুন। আরেক কাপ চা খান। হৈমন্তী গল্পটা মুখস্থ বলুন। প্লীজ। প্লীজ। বাসায় গল্পগুচ্ছ আছে, আমি বই। নিয়ে মিলিয়ে দেখব। যদি সত্যি সত্যি পারেন তাহলে…
তাহলে কি?
রূপা হাসতে হাসতে বলল, তাহলে আপনার জন্য একটা প্রাইজ আছে।
সফিক বলল, ও পারবে, ওর স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত ভাল। আমার বরাবরই খারাপ ছিল। এখন আরো খারাপ হয়েছে। প্রায়ই ব্রেইন শর্ট সার্কিট হয়ে যায়।
রূপা গল্পগুচ্ছ নিয়ে এল। হৈমন্তী গল্প বার করা হল। আমি রূপার মুখের দিকে তাকিয়ে গড়গড় করে বলে যেতে লাগলাম–কন্যার বাপ সবুর করিতে পারিতেন কিন্তু বরের বাপ সবুর করিতে চাহিলেন না। তিনি দেখিলেন, মেয়েটির বিবাহের বয়স পার হইয়া গেছে, কিন্তু আর কিছুদিন গেলে সেটাকে ভদ্র বা অভদ্র কোনো রকমে চাপা দিবার সময়টাও পার হইয়া যাইবে। মেয়ের বয়স অবৈধ রকমে বাড়িয়া গেছে বটে। কিন্তু পণের টাকার অপেক্ষিক গুরুত্ব এখনো কিঞ্চিৎ উপরে। আছে, সেই জন্যেই তাড়া। …
রূপা বলল, থামুন। আপনি ভুল করেছেন–এখনো তাহার এই দুটা শব্দ বাদ পড়েছে। মেয়ের বয়স অবৈধ রকমে বাড়িয়া গেছে বটে, কিন্তু পণের টাকার আপেক্ষিক গুরুত্ব এখনো তাহার চেয়ে কিঞ্চিৎ উপরে আছে, সেই জন্যেই তাড়া।
আমি চুপ করে গেলাম। রূপা বলল, থামলেন কেন?
আমি বললাম, আজ আর ইচ্ছা করছে না। আরেকদিন।
রূপাদের বাড়ি থেকে বের হয়েই সফিক বলল, কি, আমার কথা ঠিক হয়েছে? দেখেছিস এমন রূপবতী মেয়ে?
আমি বললাম, না, দেখিনি।
মেয়েটার চোখ নীল, তা লক্ষ করেছিস?
হুঁ।
চোখ নীল কেন বল তো?
আমি কি করে বলব?
রূপার মা হচ্ছেন লেবানীজ মেয়ে। মেয়ে তার মার রূপ পেয়েছে। চোখ এই কারণেই নীল ড্রয়িং রুমে যে সব ছবি দেখেছিস, সবই ওর মার আঁকা।
রূপার সঙ্গে পরিচয়ের এই হচ্ছে শুরু। রূপার চাচার সঙ্গে কথা হয়েছে। ভদ্রলোক রোবট জাতীয়। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন, কিছুক্ষণ পর খুব দ্রুত খানিকক্ষণ চোখ পিটপিট করেন, তারপর আবার তাকিয়ে থাকেন। কথাবার্তা বলেন, বললেও এক অক্ষরে সীমাবদ্ধ থাকে। রূপা যখন বলল, চাচা, ইনার নাম রঞ্জু।
রোবট চাচা বললেন, হুঁ।
উনি হলেন সফিক সাহেবের বন্ধু। সফিক সাহেবকে তো তুমি চেন, চেন না?
হুঁ।
ঠিক আছে চাচা, তুমি এখন যাও। এরা দুজন এসেছে ভি সি আরে একটা ছবি দেখতে–এ্যামেডিউস।
হুঁ।
আমি বললাম, এই যে আমরা প্রায়ই আসি আপনার চাচা বিরক্ত হন না?
অবশ্যই হন। তবে বিরক্ত হলেও কিছু বলেন না, কারণ আমাকে তার বাড়িতে রাখার জন্য তিনি মাসে দশ হাজার করে ঢাকা পান এবং বাবা তাকে বলে দিয়েছেন–আমাকে যেন আমার মত চলতে দেয়া হয়। চাচার ভয়ঙ্কর মানসিক কষ্ট হচ্ছে কিন্তু তিনি আমাকে আমার মত চলতে দিচ্ছেন।
মোট কবার গিয়েছি রূপাদের বাড়িতে? অনেকবার। তবে কখনো একা যাইনি। সব সময় সফিক সঙ্গে ছিল। এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রতিবারই রূপা বলেছে–দেখি আপনার স্মৃতিশক্তি কেমন, হৈমন্তী গল্পটা আবার বলুন তো। আমি মিলিয়ে দেখি। একটা না একটা ভুল আপনি প্রতিবারই করেছেন। যেদিন কোনো ভুল করবেন না সেদিন আপনার জন্যে পুরস্কার আছে।
কি পুরস্কার?
তা বলব না। তবে খুব ভাল পুরস্কার। যা আপনি কখনো কল্পনাও করেন নি।
সফিককে বাদ দিয়ে একবার আমি গেলাম একা। আমাকে একা দেখে রূপা অত্যন্ত বিস্মিত হয়েছিল।
কি ব্যাপার, একা যে! বন্ধু কোথায়?
আমি বললাম, ব্যক্তিগত প্রয়োজনে এসেছি, কাজেই একা।
রূপা আগের চেয়েও বিস্মিত হয়ে বলল, কি প্রয়োজন?
হৈমন্তী গল্পটা ভুল ছাড়া আপনাকে শোনাব।
ও আচ্ছা। গল্পগুচ্ছ নিয়ে আসুন।
গল্পগুচ্ছ আনতে হবে না। আজ যে আপনি ভুল করবেন না তা আপনার চোখ-মুখ দেখেই বুঝতে পারছি। আপনাকে একটা চমৎকার পুরস্কার দেব বলেছিলাম। তা দিতে আমি প্রস্তুত আছি। পুরস্কারটা কি আপনি কি আন্দাজ করতে পারেন?