একদিন সফিক এসে বলল, চট করে শার্টটা গায়ে দে তো–কুইক।
আমি বললাম, কেন?
পৃথিবীর সবচে রূপবতী মেয়েটিকে দেখবি। হেলেন অব ট্রয় এই মেয়ের কাছে মাতারি শ্ৰেণীর।
আমি চুপ করে রইলাম। হেলেন অব ট্রয় যে মেয়ের তুলনায় মাতরি তাকে দেখার ইচ্ছা হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু কেন জানি ইচ্ছা করছে না।
দেরি করিস না। চট করে কাপড় পর।
না।
না মানে? আমি ঐ মেয়েকে দেখার জন্য সপ্তাহে একবার করে যেতে পারি, আর তুই একদিন যেতে পারবি না?
তুই প্রতি সপ্তাহে যাস?
অফকোর্স যাই। ইন্সপাইরেশনের জন্যে যাই। আমি লেখালেখির লাইন ধরব বলে ঠিক করেছি। উপন্যাসের ওয়ান ফোর্থ লিখেও ফেলেছি। রূপাকে পড়ে শোনালাম। রূপা বলল, ব্রিলিয়ান্ট!
রূপাটা কে? ঐ রূপবতী?
হুঁ। চল যাই। আজও খানিকটা পড়ব—তুই শুনতে পারবি।
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, উপন্যাস পড়তে বা শুনতে আমার ভাল লাগে না।
না লাগলেও চল। একটা রিকোয়েস্ট রাখ। একা যেতে ইচ্ছা করছে না।
পুরানো ঢাকার যে বাড়ির সামনে নিয়ে সফিক আমাকে দাড়া করালো তার নিতান্তই ভগ্নদশা। রাজকন্যারা এ জাতীয় বাড়িতে থাকে না। দোতলা বাড়ি। একতলার সব কটা দরজা-জানালা বন্ধু। একতলাটা মনে হয় বসতবাড়ি না, দোকানপাট। একটা সাইনবোর্ড ঝুলছে–নিউ হেকিমী দাওয়াখানা। রেলিংঘেরা উঠানে পিয়াজুর দোকান। পিয়াজু ভাজা হচ্ছে। দোতলায় উঠার সিঁড়ি লোহার। সেই সিঁড়ি যে এতদিনেও ভেঙ্গে পড়ে যায়নি কেন কে জানে। শুধু সিঁড়ি না, পুরো বাড়িটাই ছোটখাট ভূমিকম্পের জন্য অপেক্ষা করছে। সিঁড়ির গোড়ায় কলিং বেল আছে। সফিক অনেকক্ষণ ধরে কলিং বেল টেপাটিপি করতে লাগল। বেল বাজছে কি-না বোঝা যাচ্ছে না। আমি কোন শব্দ শুনতে পাচ্ছি না। সফিক হাসিমুখে বলল, অনেকক্ষণ ধরে বেল টেপাটিপি করতে হয়।
বেল বাজাতে বাজাতে সফিক যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ল তখন নদশ বছরের একটি ছেলে নামল। যাকে দেখেই মনে হল অসুস্থ। চোখ-মুখ ফোলা।
কারে চান?
রূপা আছে?
আমরা রূপার বন্ধু।
নাম কি? আমার নাম বললেই হবে। গিয়ে বল সফিক।
আমরা দোতলায় উঠলাম না। একতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলাম। সফিক বলল, একতলায় রূপার নিজের একটা ড্রয়িং রুম আছে। খুব সুন্দর করে সাজানো। টেলিফোন আছে, টিভি, ভিসিআর সবই আছে। রূপার বাবা মেয়ের যা লাগে সব দিয়ে রেখেছেন।
এটা তাহলে রূপাদের বাড়ি না?
আরে না। এটা রূপার এক চাচার বাড়ি।
তাদের নিজেদের বাড়ি নেই?
আছে। সেই বাড়ি সারা বছর তালাবন্ধ থাকে। রূপার বাবা এক বছরে এগার মাস থাকে বাইরে। একটা মেয়ে তো আর একা একা থাকতে পারে না।
এগার মাস বাইরে কি করে?
ব্যবসা-ট্যাবসা করে বোধহয়। বাবার সঙ্গে মেয়ের সম্পর্কও ভাল না। অবশ্যি আমার আন্দাজ। আমি কিছু জিজ্ঞেস করিনি।
অন্য একটা ছেলে এসে একতলার একটা রুম খুলে দিল। সফিকের কথাই সত্যি। গা ছমছমানো ড্রয়িং রুম। সেখানের সাজসজ্জা এমন যে কিছুতেই পাঁচ দশ মিনিটের বেশি বসা সম্ভব না। পুরো দেয়ালজুড়ে অনেক পেইনটিং। সবই বিদেশি ল্যাণ্ডস্কেপ। চেরী গাছ, সামার হাউস, স্নো ফল….
সফিক বলল, ছবিগুলি দেখছিস?
হুঁ।
ভাল করে দেখে রাখ, পরে এই সম্পর্কে বলব। মনে করিয়ে দিস। আজকাল কিছু মনে থাকে না। প্রায়ই ব্রেইন শর্ট সার্কিট হয়ে যায়।
আমরা বসে আছি। সফিক নিচু গলায় বলল–রূপা যদি সত্যি সত্যি নেমে আসে, তাহলে ট্যারা হয়ে যাবি। আই ডিফেক্ট হয়ে যাবে। এরকম মেয়ে চোখে দেখতে পাওয়াও বড় ধরনের অভিজ্ঞতা। তবে নেমে আসে কিনা সেটাও একটা কথা। মাঝে মাঝে মেজাজ খারাপ থাকে। তখন দোতলা থেকে নামে না।
আমি বললাম, এতো বিরাট অপমানের ব্যাপার!
সফিক বলল, দূর দূর, অপমানের কিছু না। রূপার স্বভাবই এরকম। পরিচয় হলেই তুই বুঝবি।
যখন দেখা করে না, তখন কি করিস?
চা-টা খেয়ে চলে যাই। কি আর করব। রূপার একটা ভাল গুণ কি জানিস? কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে এলেই চা দিতে বলে। দেখা করুক আর না করুক। চায়ের সঙ্গে সমুচা থাকে। অপূর্ব! রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের মতো। শেষ হয়েও শেষ হয় না, জিভে স্বাদ লেগে থাকে।
মেয়েটা দেখা করে না। তারপরেও তুই এখানে আসিস?
হুঁ। এত সুন্দর মেয়ে, খানিকক্ষণ কথা বললে মনটা ভাল হয়ে যায়। তাই আসি। এখানে এলে লেখার একটা ইন্সপিরেশন হয়। লেখকদের জন্যে ইন্সপিরিশন খুব দরকার। ইন্সপিরিশনের জন্যে একজন লেখক যা ইচ্ছা করতে পারে। হট হজ এ্যালাউড।
রূপা নামল না। তবে একজন কাজের ছেলে ট্রেতে করে চা এবং সমুচা নিয়ে এল। সফিক বলল, তোকে বলেছিলাম না চা চলে আসবে। অবশ্যি এটা খারাপ সাইন। তার মানে রূপা নামবে না। চা খা। চা খেয়ে চলে যাব। এই সমুচাগুলি এ বাড়ির স্পেশাল। ভেরি ভেরি গুড। খেয়ে দেখ।
চা শেষ করবার আগেই রূপা নেমে এল। আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম। জীবনে এত অবাক হইনি। মানুষ এত সুন্দর হয়! সফিক নিচু গলায় বলল, বলেছিলাম না ট্যারা হয়ে যাবি? এইভাবে তাকিয়ে থাকিস না, চোখে লাগছে। খুব ক্যাজুয়েলি তাকিয়ে থাক। যেন কিছুই না।
রূপা সফিকের দিকে তাকিয়ে বলল, কোনো কাজে এসেছেন, না চা সমুচা। খাবার জন্যে এসেছেন?
কাজে এসেছি।
বলে ফেলুন। আমি খুব বেশিক্ষণ সময় দিতে পারব না।
এ সফিক নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, আমি আমার এই বন্ধুকে বলেছিলাম—এমন একজন মেয়ের কাছে তাকে নিয়ে যাব যাকে দেখলেই তার চোখ ট্যারা হয়ে যাবে।