এই পর্যায়ে মা কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লেন। আমি সহজ-স্বাভাবিক ভঙ্গিতে মাকে দেখছি। খুব যে খারাপ লাগছে তা না।
মা বললেন, তোর মাথা ঠিক নেই রঞ্জু। তোর মাথা ঠিক নেই। আমার ধারণা, কোনো একদিন তুই খুন-টুন করবি।
আমি মার কথায় হেসে ফেললাম। মায়ের এক অর্থে ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা, তিনি ঠিকই বলেছেন।
আজ ছুটির দিন। এ ছুটির দিনে সব্যর নানান ধরনের পরিকল্পনা থাকে। আমার কোনো পরিকল্পনা নেই। কারণ আমার ছুটি বলে কিছু নেই। গত দুবছর ধরেই আমার ছুটি। চাকরিবাকরি নেই। তার জন্যে চেষ্টাও নেই। ঢাকা শহরে আমাদের যে দুটি বাড়ি আছে, তার ভাড়াতে আমরা একটা জীবন মোটামুটি সুখে পার করে দিতে পারি। এখন যে বাড়িতে আছি, এটা ভাড়া বাড়ি। বাবার বন্ধুর বাড়ি। শুনতে পাচ্ছি এটিও নাকি কেনা হবে। বাবা মৃত্যুর সময় তিন বাড়ি তাঁর তিন পুত্র-কন্যাকে দিয়ে যাবেন।
সবচে বড় বাড়ি ধানমণ্ডি তের নম্বরের গ্রীণ কটেজ পাবে বাবু। সব পরিবারে একজন আদর্শ সন্তান থাকে, বাবু হচ্ছে সেই আদর্শ সন্তান। এম. এসসি, দিচ্ছে ফিজিক্সে। নির্ঘাৎ ফাস্ট সেকেণ্ড হবে। বাবু হচ্ছে সেই ধরনের ছেলে, যারা ফাস্ট সেকেণ্ড ছাড়াও যে কিছু হওয়া যায় তা জানে না। এরা ছুটির দিনেও দরজা-জানালা বন্ধ করে পড়ে। বাথরুমে যাবার সময়ও বগলে করে পড়ার একটা বই নিয়ে যায়। ঈদের দিন ভোরবেলা বিস্মিত হয়ে বলে—আজ ঈদ? জানতাম না তো? কি আশ্চর্য!
বাবু চিলেকোঠার একটা ঘরে থাকে, এবং তাকে বিরক্ত করা নিষেধ। ঘরে বসে। পড়তে পড়তে তার যখন মাথা ধরে যায়, তখন সে বই হাতে ছাদে ঘুরে ঘুরে পড়ে। তখন ছাদে কেউ থাকলে সে বিরক্ত গলায় বলে, এইখানে কি?
আমি বাবুর ঘরে চলে গেলাম। বাবু বই হাতে বিছানায় শুয়ে ছিল। সে বিরক্ত। গলায় বলল, কি চাও দাদা?
আমি হাই তুলে বললাম, তোর কাছে একটা পরামর্শের জন্যে এসেছি।
সে বিস্মিত হয়ে বলল, আমার কাছে কি পরামর্শ।
তোর কাছে কি পরামর্শের জন্যে আসা যায় না? সারা জীবন ফাস্ট সেকেণ্ড। হয়েছিস—তোদের ব্রেইন হচ্ছে কম্পিউটারইজড। সমস্যার খটাখট সমাধান করে। ফেলবি।
বাবু আগের চেয়েও বিরক্ত গলায় বলল, দাদা, মানুষের ব্রেইন কম্পিউটারের চেয়ে কোটিগুণ পাওয়ারফুল। কম্পিউটার মানুষের তৈরি এটা ভুলে যাও কেন?
সবার ব্রেইন তো আর পাওয়ারফুল না। কিছু কিছু ব্ৰহন আছে ইটের টুকরার মতো। সলিড রক।
তোমার সমস্যাটা কি দাদা অল্প কথায় বলে চলে যাও। আমি জটিল একটা বিষয় পড়ছি–নন নিউটোনিয়ান ফ্লো প্যাটার্ন …।
আমি বসতে বসতে বললাম, একটা খুন করতে চাচ্ছি, বুঝলি–পারফেক্ট না মর্ভিার। কিভাবে করব বুঝতে পারছি না।
ঠাট্টা করছ নাকি? না।
ঠাট্টা করব কেন। তুই ভেবেটেবে একটা কায়দা বের কর তো।
কাকে খুন করবে?
আন্দাজ করতো।
রূপা ভাবীকে?
ঠিক ধরেছিস।
রূপা ভাবীকে খুন করবে কেন?
আমি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললাম, এত মানুষ থাকতে তোরই বা রূপার কথা মনে হল কেন?
বাবু থতমত খেয়ে গেল। আমি উঠতে উঠতে বললাম, খুব ভালমতো চিন্তাভাবনা করে তারপর আমাকে বলবি। হুট করে কিছু বলবি না। খুনটা হবে টেক্সট বুক মার্ডার। কোনো রকম ভুলচুক থাকবে না।
বাবু বিড়বিড় করে বলল, তোমার মাথা আগেও খারাপ ছিল এখন আরো বেশি খারাপ হয়েছে। তোমার চিকিৎসা হওয়া দরকার। দাদা, তুমি কি ড্রাগ-ট্রাগ কিছু খাও?
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, খাই না, তবে খেয়ে দেখব বলে ভাবছি। ইন্টারেস্টিং ড্রাগ কি আছে বল তো।
আমাদের পরিবারের আদর্শ মানব বাবু বিরক্ত মুখে বই পড়তে শুরু করেছে–নন নিউটোনিয়ান ফ্লো মেকানিক্স। অতি জটিল বিষয়, সে নিশ্চয়ই জলের মতো বুঝতে পারছে। তবে সহজ জিনিস সে কিছু বোঝে না বলেই আমার বিশ্বাস। বাবু ভুরু কুঁচকে বলল, দাদা, এখন যাও তো। মূর্তির মতো বসে আছি, আমার খুব বিরক্ত লাগছে।
আমি উঠে পড়লাম। আদর্শ মানবকে বেশিক্ষণ বিরক্ত করা ঠিক না। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় দেখি, লাবণ্যও নামছে। চুল বেঁধে, মুখে পাউডার দিয়ে একেবারে পরীদের ছানা। পায়ে লাল ভেলভেটের জুতা। আমি বললাম, এমন সেজেছিস কেন রে লাবণ্য?
লাবণ্য হাসিমুখে বলল, বাবা আমাকে দেখতে এসেছে।
ও আচ্ছা। খুব আনন্দ হচ্ছে?
হচ্ছে।
একা একা বাবার কাছে যেতে পারবি, নাকি আমাকে সঙ্গে যেতে হবে?
একা যেতে পারব।
লাবণ্য রেলিং ধরে খুব সাবধানে নামছে। এই সাবধানতা তার নতুন জুতার জন্যে।
আমি দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। লাবণ্যর বাবার গাড়ি এখান থেকে দেখা যাচ্ছে। গাড়িতে রোগামতো একটি মেয়ে বসে আছে। এই বোধহয় ভদ্রলোকের নতুন স্ত্রী। মেয়েটা মাথায় ঘোমটা দিয়ে বৌ বৌ ভাব নিয়ে এসেছে।
আমি আবার আমার ঘরে ঢুকলাম। আমাদের বিছানায় মুনিয়া উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মুনিয়ার পিঠে হাত দিয়ে বসে আছে রূপা। আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই রূপা তীব্র স্বরে বলল, প্লীজ লিভ আস এলোন।
এই ইংরেজি বাক্যটির সুন্দর বাংলা কি হবে–দয়া করে আমাদের একা থাকতে দাও–নাকি পায়ে পড়ি আমাদের একা থাকতে দাও?
রূপার সঙ্গে কি করে পরিচয় হল
রূপার সঙ্গে কি করে পরিচয় হল সেটা বলি।
আমার ছেলেবেলার বন্ধু সফিক। ভুল বললাম, বন্ধু বলে আমার কেউ নেই। যাদের আমি খানিকটা সহ্য করতে পারি তাদেরই বন্ধু বলার চেষ্টা করি। স্কুলে এবং কলেজে যাদের সঙ্গে আমি পড়েছি তাদের মধ্যে একমাত্র সফিককেই খানিকটা সহ্য করতে পারি। তাও সব সময় নয়, মাঝে মাঝে। সে গত বছর ডাক্তারি পাশ করেছে। এখনো বেকার। ডাক্তারও যে বেকার থাকে তা সফিকের সঙ্গে পরিচয় না থাকলে কোনোদিনও জানতাম না। তাকে ইদানীং দেখায় একজন লেখকের মতো। তার চুল লম্বা। গায়ে ময়লা পাঞ্জাবি, পায়ে টায়ারের সোল লাগানো স্যাণ্ডেল। তাকে। সারাক্ষণই খুব উত্তেজিত দেখা যায়। এক জায়গায় বসে একটা দীর্ঘ বাক্য সে বলতে পারে না, লাফ দিয়ে উঠে পড়ে। আবার বসে।