মুনিয়া প্রায়ই আমাকে ঠাট্টা করে বলে—ভাইয়া, তোকে তো ভাবী একেবারে মেষশাবক বানিয়ে ফেলেছে। মেরী হ্যান্ড এ লিটল ল্যাম্ব অবস্থা। মেরী যেখানে যায় মেষশাবক যায় তার পিছু পিছু।
ও তো যায় না কোথাও। শুয়ে থাকে, ঘুমায়।
পাগল হয়েছ ভাইয়া, চব্বিশ ঘণ্টা কেউ ঘুমুতে পারে। আমার ধারণা, ভাবী মোটেই ঘুমোয় না। মটকা মেরে পড়ে থাকে।
মটকা মেরে পড়ে থাকবে কেন?
তা জানি না। আমি আমার ধারণার কথা বললাম। তুমি হা করে ভাবীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালবাস, এটা ভাবী জানে বলেই চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকে, যাতে মনের সাধ মিটিয়ে তুমি দেবীদর্শন করতে পার।
চুপ কর তো।
চুপ করছি। আমার ধারণা ভুল নাও হতে পারে ভাইয়া। ভাবী যখন ঘুমায়, তখন তুমি ভালমতো পরীক্ষা করে দেখো তো। সত্যি ঘুম কিনা।
আমি সেই পরীক্ষাও করেছি।
ও যখন ঘুমুচ্ছে তখন পাশে বসে মজার মজার কয়েকটা জোক বলেছি। জেগে থাকলে তাকে হাসতেই হবে। সে হাসেনি। তার ঘুম যে নকল ঘুম না—আসল ঘুম, তা সে না হেসে প্রমাণ করেছে।
মুনিয়াকে আমি আমার এই পরীক্ষার কথা বলেছি। সে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারেনি। তার ধারণা, রূপার হাসি আসেনি বলে হাসেনি। সে বলল, জেগে থাকা অবস্থায় এ রসিকতাগুলো করে দেখো তো—ভাবী হাসে কিনা। আমার মনে হয় হাসবে না। যা একদিন তাও করলাম। রূপা হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ল। এমন হাসল যে তার চোখে পানি এসে গেল। হেঁচকি উঠতে লাগল। এই ব্যাপারটাও সন্দেহজনক, এত হাসবে কেন? এত হাসির কি আছে?
রূপা ঘুমুচ্ছে।
আমি তার খাটের পাশে রাখা টুলে বসে তাকিয়ে আছি তার মুখের দিকে। এই ঘর থেকে বের হয়ে যাবার সাধ্যও আমার নেই। আট মাস আমাদের বিয়ে হয়েছে। এই আট মাসে স্ত্রীর প্রতি আকর্ষণ খানিকটা হলেও ফিকে হবার কথা। আমার তা হচ্ছে না–কারণ এই মেয়েটাকে আমি একেবারেই বুঝতে পারছি না। প্রথম দিনে সে আমার কাছে যতটা অচেনা ছিল, আজও ঠিক ততটাই অচেনা আছে। কিংবা হয়তো আরো বেশি অচেনা হয়েছে।
আমি একটা সিগারেট ধরালাম।
রূপা বলল, আহ, সিগারেট ফেল তো। গন্ধে বমি আসছে।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, তুমি কি জেগে ছিলে নাকি?
রূপা বিরক্ত গলায় বলল, জেগে থাকব কেন? সিগারেটের ধোঁয়ায় ঘুম ভেঙেছে। দয়া করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট শেষ করে এসো।
আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সিগারেট হাতে বারান্দায় চলে এলাম। সজনে গাছটার দিকে তাকিয়ে মন খারাপ হয়ে গেল। গাছটা মরে যাচ্ছে। খুব ধীরে ধীরে মরছে। এত ধীরে মরছে যে অন্য কেউ তা বুঝতে পারছে না। গাছদেরও কি মৃত্যু-যন্ত্রণা আছে? জগদীশচন্দ্র বসু গাছের মৃত্যু-যন্ত্রণা নিয়ে কি বলে গেছেন?
আমার সিগারেট শেষ হবার আগেই বাবা বারান্দায় এসে পড়লেন। আমি নিতান্ত অনিচ্ছায় হাত থেকে সিগারেট ফেলে দিলাম। বাবা রাগী চোখে আমরা দিকে তাকাচ্ছেন। আমি বললাম, কিছু বলবেন?
সচরাচর বাবাকে তুমি করে বলি। মাঝে মাঝে বিশেষ অবস্থায় আপনি বলি। বাবা তুই-তুমির মিশ্রণ ব্যবহার করেন, এই তুই এই তুমি।
বাবা বললেন, তোর সঙ্গে আমার অনেক কথাই আছে।
এখন বলবেন?
না।
বলতে চাইলে বলতে পারেন, আমার হাতে সময় আছে।
বাবা ইংরেজিতে একটি দীর্ঘ বাক্য বললেন যার বাংলাটা হল, মানুষ হিসেবে তুমি দ্রুত বদলে যাচ্ছ। তুমি নিজে তা বুঝতে পারছ কিনা তা আমি জানি না। তবে তোমাকে যতই দেখি ততই শঙ্কিত বোধ করি। তোমার কি রাতে ঘুম হয়?
আমি বললাম, হুঁ।
কোনো জবাব না।
ঘুম হয় কি হয় না?
হয়।
শুনে সুখী হলাম। তোর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয় তোর ইদানীং ঘুম হচ্ছে না। লজিক এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তোর মধ্যে আত্মসম্মান বলতে এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। তোর স্ত্রী এমন অদ্ভুত আচরণ করল, আর তুই তাকিয়ে রইলি, কিছুই বললি না? তোর কি মনে হয় না–কিছু বলা উচিত ছিল?
রূপার কথা আমার কাছে বেশ লজিকেল মনে হয়েছে।
লজিকেল মনে হয়েছে?
জী।
আমার কথাগুলি কেমন মনে হয়েছে? আমার কথাগুলি কি পাগলের চেঁচামেচি বলে মনে হয়েছে?
আমি জবাব দেবার আগেই রূপা বারান্দায় এসে বলল, তোমরা এত হৈচৈ শুরু করেছ! ঘুমুচ্ছিলাম তো।–বলেই আবার ভেতরে ঢুকে গেল। শব্দ করে দরজা বন্ধ করল। বাবা হতভম্ব হয়ে বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তিনি বোধহয় অনেকদিন এত বিস্মিত হননি। বাবার বিস্মিত চোখ দেখে মজা লাগছে। মানুষ খুব বেশি বিস্মিত হলে খানিকটা টিকটিকির মতো হয়ে যায়। কারণ তার চোখ বড় বড় হয়ে যায় এবং কোটর থেকে খানিকটা বের হয়ে আসে। আমি কি বাবাকে বলব যে তাঁকে এখন কালো টিকটিকির মতো দেখাচ্ছে? বলে আরো রাগিয়ে দেব? চূড়ান্ত রকম রেগে গেলে বাবা কি করেন তা কেন জানি দেখতে ইচ্ছা করছে।
মাকে একবার চূড়ান্ত রকম রাগিয়ে দিয়েছিলাম। এক সময় লক্ষ করলাম, তিনি থরথর করে কাঁপছেন। ঠোঁটের দুই কোণায় ফেনা জমছে। তিনি ক্ষীণ গলায় বললেন, রঞ্জু, তুই যে খুব খারাপ ধরনের ছেলে, এটা কি তুই জানিস?
আমি মার প্রতি একটু করুণাই বোধ করছিলাম। তবু বললাম, আমি যে খুব খারাপ ধরনের ছেলে তা আমি জানি, কিন্তু তুমি যে খুব খারাপ ধরনের একজন মা, তাকি তুমি জান?
কি বললি? তুই কি বললি?
সত্যি কথা বললাম মা।
আমি খারাপ ধরনের মা?
হ্যাঁ। তুমি খারাপ ধরনের মা এবং খারাপ ধরনের স্ত্রী। মা হিসেবে তুমি যেমন ব্যর্থ, স্ত্রী হিসেবেও ব্যর্থ। আমার ধারণা, শিক্ষক হিসেবেও তুমি ব্যর্থ। স্কুলের। মেয়েরা তোমাকে ডাইনী ডাকে। তুমিই এই কথা বলেছিলে। তোমার কাছ থেকেই শোনা।