বাবা বললেন, বাথরুমের ফুটো দিয়ে কোনো মহিলার দিকে তাকানো জঘন্য অপরাধগুলোর একটি। রইসুদ্দিনকে বলতে হবে, সে যেন সকাল এগারোটার আগেই বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। আর কোনো দিন যেন না আসে। এইসব ন্যুইসেন্সদের বাড়িতে জায়গা দেয়াই ঠিক না।
রূপা বলল, আমার কিছু কথা আছে।
বাবা বিস্মিত হয়ে তাকালেন। আমি খুব দ্রুত চিন্তা করলাম, আরেকবাবু পায়ে চাপ দিয়ে রূপাকে থামানোর চেষ্টা করাটা কি ঠিক হবে? সে অবশ্য আবার উফ! কি করছ? বলে চেঁচিয়ে উঠতে পারে।
মা বললেন, বৌমা, এই বিষয়ে তোমার কিছু বলার দরকার নেই।
কেন মা?
তুমি সব ব্যাপারে কথা বল, এটা ভাল না। তুমি বৌ মানুষ। সংসারের সব কিছুতে তুমি থাকবে কেন?
বৌরা কি সংসারের অংশ নয়?
অংশ তো বটেই, তবে তারা হচ্ছে সংসারের সৌন্দর্য, সংসারের শোভা। তারা নোংরা ঘাঁটাঘাঁটি করবে, এটা ঠিক না।
নোংরা ঘাঁটাঘাঁটি তো না মা। আমি যা বলতে চাচ্ছি তা হল, আমার ধারণা মতির মা মিথ্যা কথা বলছে।
মিথ্যা কথা বলছে?
হ্যাঁ।
এ রকম ধারণা হবার কারণ কি?
রইসুদ্দিন চাচা কিছুদিন আগে বলছিলেন না—তার পাঞ্জাবির পকেট থেকে মতির মা পঞ্চাশ টাকার একটা নোট সরিয়েছে। মতির মা কান্নাকটি করল। আপনার হুঁকুমে মতির মার ট্রাংঙ্ক খোলা হল। পঞ্চাশ টাকার একটা নোট সেখানে পাওয়া গেল।
এত ফেনাচ্ছ কেন মা? যা বলতে চাও সহজ কথায় বল।
বেশ, সহজভাবেই বলছি। মতির মা সেই অপমানের প্রতিশোধ নিয়েছে, আর কিছুই না। বাহান্ন বছরের এক বুড়ির শরীর দেখার জন্যে কেউ বাথরুমের ফুটোয় চোখ রাখে না।
কেউ রূপার কথা বিশ্বাস করল কি না জানি না, আমি করলাম। এবং মুনিয়ার ঠোঁটের কোণে হাসি দেখে মনে হল সেও করল।
বাবা গলার স্বর যথাসম্ভব গম্ভীর করে বললেন, বৌমা, আমার দৃঢ় বিশ্বাস মতির মা সত্যি কথা বলছে। কে সত্যি বলছে, কে বলছে না সেটা আমি বুঝতে পারি। তিরিশ বছর জজিয়তি করেছি। তোমাকে আরেকটা কথাও বলি মা, পৃথিবীতে অনেক বিকারগ্রস্ত মানুষ আছে। তারা বাথরুমে ফুটো দেখলেই চোখ রাখবে। রইসুদ্দিন এরকম একজন বিকারগ্রস্ত লোক। তাকে আজ সকাল এগারেটার মধ্যে বাসা ছাড়তে হবে। এই প্রসঙ্গে আমি আর কারোর কথা শুনতে চাই না।
রূপা বলল, জাজ সাহেব হিসেবে আপনার দুপক্ষের কথাই শোনা উচিত। আসামীরও তো কিছু বলার থাকতে পারে।
বৌমা, তুমি আমার সামনে থেকে যাও।
আচ্ছা যাচ্ছি, না বললেও যেতাম। আমার খাওয়া শেষ হয়ে গেছে।
রূপা খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উঠে গেল, যেন কিছুই হয় নি।
এগারোটার আগেই রুইলুদ্দিন চাচাকে তার স্যুটকেস, কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে রিকশায় উঠতে হল। মতির মাকে খুব উৎফুল্ল মনে হল। আমাকে দেখে হাসিমুখে বলল, ভাইজান, দেখছেন, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে।
আমি গম্ভীর গলায় বললাম, ধর্মের কল বাতাসে নড়বে না তো কিসে নড়বে?
খুবই খাঁটি কথা ভাহজান। খুব খাঁটি কথা। লোকটারে প্রথম দিন দেইখ্যাই বুঝছি বুদ লোক।
সেও তোমাকে দেখে প্রথমদিনেই বুঝে ফেলেছে, তুমি বদ মেয়েছেলে। দেখ না, এত লোক থাকতে তোমাকে চোর সাব্যস্ত করল। শুধু যে চোর সাব্যস্ত করল তা না, চোর প্রমাণও করে ফেলল। টাকা পাওয়া গেল তোমার ট্রাঙ্কে।
মতির মা মুখ কালো করে ফেলল।
আমি বললাম, রইসুদ্দিন চাচাকে তুমি চেন না মতির মা। উনি বিরাট ঘুঘু লোক। প্রতি বছর ছয়-সাতটা করে মামলা করে। সে তোমাকে এত সহজে ছাড়বে বলে মনে হয় না। মামলা-টামলা করে বসবে বলে আমার ধারণা।
মতির মাকে পুরোপুরি ভ্যাবাচেকা খাইয়ে ঘরে এসে দেখি রূপা চাদর জড়িয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। নির্ঘাৎ ঘুমিয়ে পড়েছে। নাশতা খেয়ে আবার বিছানায় এসে ঘুমিয়ে পড়া রূপার পুরনো অভ্যাস। প্রথমদিকে অবাক হতাম। এখন আর হই না।
রূপা ঘুমাচ্ছ নাকি?
না, চেষ্টা করছি।
তোমার যুক্তি কেউ বিশ্বাস করেছে বলে মনে হয় না।
সবাই বিশ্বাস করেছে। লোকটাকে তোমরা কেউ সহ্য করতে পারছিলে না। একটা অজুহাত পেয়ে তাড়িয়েছ।
তুমি কি লোকটাকে পছন্দ করতে?
আরে দূর দূর। আমি পছন্দ করব কেন? মামলাবাজ লোক আমার অসহ্য। এই, একটা গান দাও না। গান শুনতে শুনতে ঘুমাই।
এখন গান দেয়া যাবে না। বাবা গান শুনলেই রেগে যান।
রেগে যান কেন?
জানি না কেন। ছোটবেলা থেকেই দেখছি গান শুনলে বাবার মেজাজ চড়ে যায়। মুনিয়া একদিন উঁচু ভলুমে অনুরোধের আসর শুনছিল বলে চড় খেয়েছিল।
তোমার বাবা লোকটাকে আমি খুবই অপছন্দ করি। তিনিও অবশ্যি আমাকে অপছন্দ করেন। কাজেই কাটাকাটি।
মা। মাকে পছন্দ কর?
মাই গড। ওনার ভেতর পছন্দ হবার মতো কি আছে?
কিছুই নেই?
না, কিছুই নেই। এই শোন, একটা গান দাও না। গান শুনতে শুনতে ঘুমানোর অন্য রকম মজা। ঘুমের মধ্যেও গান হতে থাকে।
না ঘুমিয়ে একটা কাজ করলে কেমন হয় রূপা?
কি কাজ?
চল না কোথাও বেড়াতে যাই।
পাগল হয়েছ। এই রোদে আমি ঘুরব? গায়ের রঙ নষ্ট হয়ে যাবে না?
বাবাকে বলে গাড়িটা নিয়ে যাই। গাড়িতে গেলে তোমার গায়ের রঙ নিশ্চয়ই নষ্ট হবে না?
রূপা জবাব দিল না। আমি কয়েকবার ডাকলাম, এই রূপা, এই। কোনো সাড়া নেই। সে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি কি করবো ভেবে পেলাম না। চুপচাপ ঘরে বসে থাকব, নাকি বাইরে যাব। রূপাকে বিয়ের পর থেকে মোটামুটিভাবে আমি গৃহবন্দী হয়ে পড়েছি। বাইরে যেতে ভাল লাগে না। রূপার আশেপাশে থাকতে ইচ্ছা করে। বেশির ভাগ সময় সে ঘুমিয়ে থাকে। আমি তার পাশে শুয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকি। রূপার গা ঘেঁষে শোয়া যায় না—তার গরম লাগে। তার গায়ে হাত রাখা যায় না—ভার লাগে, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।