আমার কাছ থেকে কেউ যা আশা করে, আমি তা করি না। কাজেই কিছুই বললাম না। উদাস চোখে বারান্দায় লাগোয়া সজনে গাছের দিকে তাকিয়ে রইলাম। সজনে গাছটা মরতে বসেছে। গাছের মৃত্যুও একটা দেখার মতো ব্যাপার। কিছু কিছু গাছ হঠাৎ করে মরে যায়। ওদেরও মনে হয় হার্ট এ্যাটাকের মতো অসুখ আছে। আবার কিছু কিছু গাছ দীর্ঘদিন রোগ ভোগ করে মরে। এই গাছটা অল্প অল্প করে মরছে। গাছের কোনো ডাক্তার থাকলে তাকে এনে চিকিৎসা করাতাম।
রইসুদ্দিন চাচা কি করেছেন জানিস?
না।
মতির মা আমাকে বলল, ওদের যে বাথরুম রহসুদ্দিন চাচাকেও সেই বাথরুম ব্যবহার করতে হয়। বাথরুমের দরোজায় একটা ফুটো। মতির মা গোসল করছে, হঠাৎ দেখে সেই ফুটো দিয়ে রইসুদ্দিন চাচা তাকিয়ে আছেন। কি রকম ঘেন্নার কথা বল তো!
মতির মা কি ওনাকে কিছু বলেছে?
না। ভাবছি আমি বলব। অবশ্যি সবচে ভাল হয় তুই বললে।
পাগল, আমি এইসব বলাবলির মধ্যে নেই। খুন করার কথা হলে ভিন্ন কথা।
আমি নিজের ঘরে চলে এলাম। রুপা এখনো শুয়ে আছে। আমাকে ঢুকতে দেখেই বলল, কফির কথা বলেছ?
বলেছি।
পানি আননি, ঠাণ্ডা পানি?
কফির সঙ্গে আসবে।
তাহলে দয়া করে একটা গান দাও তো। গান শুনতে ইচ্ছা করছে। এলপিটা দেখে টেবিলের ওপর–চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে, ঐটা দাও। ই আমি তাই করলাম।
ও রূপা হাসতে হাসতে বলল, গানটা শুনতে শুনতে তোমার পা একটু ধরতে চাই। কাছে এসো তো। ঠাট্টা না, সত্যি। কাছে এসো।
আমি রূপার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
রূপা হাসছে। তাকে অসহ্য সুন্দর লাগছে। মানুষ এত সুন্দর হয় কি করে? চোখ ফিরিয়ে নেবার চেষ্টা করেও পারছি না। গান বাজছে। গানের কথাগুলো কেমন যেন অস্পষ্ট হয়ে আসছে—তবু পুরোপুরি অস্পষ্ট নয়।
চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে, নিয়ো না, নিয়ো না সরায়ে–
এ জীবন মরণ সুখ-দুখ দিয়ে বক্ষে ধরিবো জড়ায়ে।।
স্খলিত শিথিল কামনার ভার বহিয়া বহিয়া ফিরি কতো আর–
নিজ হাতে তুমি গেঁথে নিয়ে হার, ফেল না আমারে ছাড়ায়ে।।
রূপার চোখ বন্ধ। মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে পড়েছে। নিশ্চিত হবার জন্যে আমি পর পর দুবার ডাকলাম, রূপা রূপা। সে সাড়া দিল না। পাশ ফিরল। অথচ ট্রে হাতে মুনিয়া ঢোকামাত্র রূপা বলল, থ্যাংকস মুনিয়া।
রূপা নিশ্চয়ই ঘুমুচ্ছিল না। কিংবা ঘুমের মধ্যেই এমন ব্যবস্থা ছিল যেন মুনিয়া ঢোকামাত্র সে জেগে যায়। কম্পিউটারাইজড কোন সুইচিং ডিভাইস। রূপা বিছানায় উঠতে উঠতে বলল, লাবণ্য কি করছে মুনিয়া? ওকে একটু পাঠাবে।
মুনিয়া গম্ভীর মুখে বলল, ও বই নিয়ে বসেছে। ওকে এখন ডেকো না তো ভাবী।
আচ্ছা, ডাকব না।
লাবণ্য মুনিয়ার একমাত্র মেয়ে। লাবণ্যর বয়স পাঁচ। সপ্তাহে অন্তত একদিন তাকে তার বাবা দেখতে আসেন। সেই বিশেষ দিনে মুনিয়া তার ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে থাকে। সারাদিন কিছুই খায় না।
রূপার সঙ্গে লাবণ্যের অন্য একধরনের ভাব আছে। সেই ভাবের গুরুত্ব এত বেশি, যা মা হিসেবে মুনিয়া ঠিক সহ্য করতে পারে না। মুনিয়া চলে যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে লাবণ্য ঘরে ঢুকল। গম্ভীর গলায় বলল, পিরিচে করে চা খাব।
রূপা তাকে পিরিচে চা ঢেলে দিল।
কেমন আছ লাবণ্য?
লাবণ্য গম্ভীর গলায় বলল, কি জানি কেমন আছি।
মনটা কি তোমার খারাপ?
হুঁ।
কি করলে মন ভাল হবে?
জানি না।
পিরিচে করে আরো চা খেলে কি ভাল হবে?
হুঁ।
রূপা আরো খানিকটা চা ঢেলে দিল। মুনিয়া আবার ঘরে ঢুকল। এই পর্যায়ে মুখ কালো করে বলল, ভাবী, তুমি ওকে আবার চা দিয়েছ? আমি তোমাকে বলিনি চা খাওয়ানোর অভ্যাস করবে না। এই দেখ, নতুন জামায় চায়ের দাগ লাগিয়েছে।
মুনিয়া মেয়ের হাত ধরে বের হয়ে গেল। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে জামায় চায়ের দাগ লাগার শোকে সে কেঁদে ফেলবে। আসলেই কাঁদবে। কারণে এবং অকারণে কাঁদা তার শৈশবের অভ্যাস। এখন তার কাদার অনেক বিষয় আছে।
আজ শুক্রবার।
মার হুঁকুমে শুক্রবার সকালে নাশতা সবাইকে একসঙ্গে খেতে হয়। মা অজিমপুর গার্লস স্কুলে মাস্টারি করেন। মর্নিং শিফটের ক্লাস আটটায় আরম্ভ হয়। তাঁকে সাতটার মধ্যে বাড়ি থেকে বের হয়ে রিকশা খুঁজতে হয়। বাবার গাড়ি আছে। তিনি সেই গাড়িতে যাবেন না। বাবার টাকায় নিজের জন্যে কিছু কিনবেন না। সম্ভবত বছর পাঁচেক আগে তাদের মধ্যে বড় ধরনের কোনো ঝগড়া হয়েছে। সে ঝগড়ার জের এখনো চলছে। কে জানে হয়তো আরো বছর পাঁচেক চলবে। ঐ নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই না। তা ছাড়া ঝগড়ার কারণে তাদের কথাবার্তা পুরোপুরি বন্ধ না। কাজ চালাবার মতো কথা তারা বলেন।
নাশতার টেবিলে বাবা মার দিকে তাকিয়ে বললেন–রইসুদ্দিনের ব্যাপারটা কি বল তো?
মা জবাব দিলেন না। জবাব দেবার অবশ্যি কথাও না। বাবা রুটিতে মাখন। লাগাতে লাগাতে বললেন, মতির মা কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বলল, রহসুদ্দিন নাকি বাথরুমের ফুটো দিয়ে তাকিয়ে ছিল। কি অসম্ভব কাণ্ড!
মুনিয়া বিরক্ত গলায় বলল, ও কি সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে নাকি? এটা কি জনে জনে বলে বেড়াবার মতো কথা?
বাবা বললেন, না বলারই-বা কি আছে? তার ওপর একটা অন্যায় করা হয়েছে, সে বিচার দাবি করবে না? সেই অধিকার কি তার নেই?
মুনিয়া কি যেন বলতে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে রূপা উঁচু গলায় বলল, বাথরুমের ফুটো দিয়ে মতির মাকে দেখেছে, তাতে হয়েছেটা কি? মতির মার শরীর তো পচে যায়নি।
বাবা রূপার কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন। তাঁর ছেলের বৌ তার মুখের ওপর এরকম কথা বলবে, তা তিনি হয়তো কল্পনাও করেননি। রূপার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে তিনি আমার দিকে তাকালেন। তাঁর চোখের দৃষ্টি বলছে, এই রকম একটা মেয়েকে তুই বিয়ে করলি? রূপা যেন আরো বেফাস কিছু বলে না ফেলে, সে জন্যে টেবিলের নিচে তার পায়ের পাতায় আমি ডান পা নিয়ে চাপ দিলাম। সে আমার দিকে তাকিয়ে উফ কি করছ? বলে ধমক দিল। আমি হয়ে গেলাম অপ্রস্তুত। রূপ কোনো ব্যথা পায়নি। পুরো ব্যাপারটা সে করল আমাকে অপ্রস্তুত করার জন্যে। বা