আমি বললাম, থাক এসব।
রূপা বলল, থাকবে কেন? আমি তো বলতে লজ্জা পাচ্ছি না। তুমি শুনতে লজ্জা পাচ্ছ কেন? আমার মা প্রতিটি ঘটনা আমাকে বলেছেন। যখন বলেছেন তখন আমার বয়স খুব অল্প। তিনি বলতে লজ্জা পান নি, আমিও মার কথা শুনে লজ্জা পাইনি। তুমি কেন পাবে? মা বলতেন–শরীর এবং মন আলাদা আলাদা। শরীর অশুচি হলেই মন অশুচি হয় না। এটা হয়ত তিনি নিজেকে সান্ত্বনা দেবার জন্যেই বলতেন।
মা ভয়ংকর জীবন বেছে নিয়েছিলেন। আমার বাবা তাঁকে সেখান থেকে উদ্ধার করেন। বিয়ে করেন। দেশে নিয়ে আসেন। মার সমস্ত দুঃখ, সমস্ত কষ্ট ভুলিয়ে দিতে চেষ্টা করেন। কেমন লাগছে তোমার গল্পটা?
ভাল?
শুধু ভাল? এটা কি চমৎকার একটা গল্প না?
হ্যাঁ চমৎকার গল্প।
এই চমৎকার গল্পের একটা ভয়ংকর অংশ আছে। সেই অংশটা এখন আমি তোমাকে বলব।
বল।
বাবা যখন আমার মাকে বিয়ে করেন তখন আমার মা অন্তঃসত্তা। আমার মা ঠিক জানেন না–আমার বাবা কে। এইসব কিছুই আমি তোমাকে বলিনি। এখন। বললাম, কারণ পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে। আমার চাচার বাবার সম্পত্তির জন্যে মামলা মোকদ্দমা করবেন। একজন অবৈধ কন্যা বিপুল সম্পত্তি পাবে তা তো হয় না। বাবার শরীর অসুস্থ। তিনি যে দীর্ঘদিন বাইরে থাকেন চিকিৎসার জন্যে থাকেন। সম্পত্তি নিয়ে কথাবার্তা বলার সময় এসে গেছে।
আমি চুপ করে আছি। দেখছি রূপাকে। মানুষ কি করে এত সুন্দর হয়!
রূপা বলল, আমি এখন যে কথাগুলি বললাম তা কি তুমি তোমার বাবা, মা, ভাইবোন–এদের বলতে পারবে?
না।
আমার ধারণা হয়েছিল পারবে। আমি এমন একজনকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম যে সবকিছু তুচ্ছ করে আমাকে গ্রহণ করতে পারবে। আমার চারপাশে অনেকেই ছিল। তিনজনের একটা তালিকা তৈরি করেছিলাম। তুমি ছিলে দু নম্বরে।
এক নম্বরে কে ছিল?
সফিক ছিল এক নম্বরে।
রূপা হাই তুলতে তুলতে বলল, আমি ঘুমুব। আমাকে একটু জায়গা দাও তো। সে এসে আমার পাশে শুয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে পড়ল প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। আমি সন্ধ্যা পর্যন্ত জেগে তার পাশে বসে রইলাম। সে গভীর ঘুমে অচেতন। ঘুমের মধ্যেই হাসছে, স্বপ্ন দেখছে হয়ত।
সন্ধ্যা মিলাবার পর বেরুলাম। মুনিয়ার স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে হবে। সেখান থেকে একবার যাব সফিকের কাছে। তারপর? তারপর কি আমি জানি না। একটা সাইকেল থাকলে ভাল হত। সাইকেলে করে সারা শহর চক্কর দেয়া যেত।
মুনিয়ার স্বামী আজহার সাহেব
মুনিয়ার স্বামী আজহার সাহেব আমাকে একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেলেন। দীর্ঘ ভনিতার পর যা বললেন তা হচ্ছে–তিনি ভুল করেছেন। ভুল সংশোধন করতে চান। মুনিয়া এবং লাবণ্যকে নিয়ে আবার সংসার শুরু করতে চান। আমি বললাম, যে মেয়েটিকে বিয়ে করেছেন তার কি হবে? তিনি বিরক্ত মুখে বললেন–ও চুলোয় যাক। হুঁ কেয়ারস? আপনি ভাই একটা ব্যবস্থা করে দিন। আমি চির কৃতজ্ঞ থাকব। মানুষ ভুল করে না? আমি একটা ভুল করে ফেলেছি …
আমি হালকা গলায় বললাম, আপনি দেরি করে ফেলেছেন।
দেরি মানে?
মুনিয়ার বিয়ে ঠিকঠাক হয়ে গেছে।
সে কি?
সে কি বলছেন কেন? তার এমন কি বয়েস। সে বিয়ে করবে না? মোটামুটি বেশ ভাল একটা ছেলের সঙ্গেই বিয়ে ঠিক হয়েছে। ছেলেটিকে তার খুব পছন্দ।
আমি তো এইসব কিছু জানি না।
আপনার জানার কথাও না। ছেলেটিকে তার পছন্দ, কারণ প্রায়ই দেখি দুজন চায়নিজ টায়নিজ খেতে যায়।
কি বলেন এসব! মুনিয়া এটা করতে পারে না।
পারছে তো?
ঐ ছেলের ঠিকানা কি?
এখন আপনাকে ঠিকান্য দেব না। ঠিকানা দিলে ঝামেলা করতে পারেন। বিয়ে হোক, তারপর ঠিকানা পাবেন। আমি বরং মুনিয়াকে বলব সে যেন তার স্বামীকে নিয়ে আপনাদের বাসায় বেড়াতে যায়।
আজহার সাহেব অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে তাঁর ভুবন উলট পালট হয়ে গেছে। আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম–যাই? আমার এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে হবে।
সফিককে দেখে চিনতে পারছি না।
ইয়া দাড়ি–ইয়া বাবরি চুল। গায়ে চক্রাবক্রা শার্ট, কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ এবং চোখে কালো চশমা। সফিক বলল, কি ব্যাপার বাক্যহারা হয়ে গেলি?
আমি বিস্মিত গলায় বললাম, দাড়ি কবে রাখলি?
দাড়ি কবে রাখলি মানে? এই দাড়ির বয়স চার মাস। গত চার মাসে খুব কনজারভেটিভ এস্টিমেট নিলেও তোর সঙ্গে তিনবার দেখা হয়েছে। এখন তুই জিজ্ঞেস করছিস দাড়ি কবে রাখলি?
সরি, আগে লক্ষ্য করিনি।
তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমার তো মনে হচ্ছে তুই আমাকে চিনতে পারছিস না। বলতো আমি কে? ঠাট্টা না। আই এ্যাম সিরিয়াস, বল,আমি কে?
সফিকের কথার জবাব দিলাম না। সে আমাকে তাদের বাসার সামনের চায়ের দোকানে নিয়ে গেল। হাসি মুখে বলল, তোকে বাসায় নেয়া যাবে না, আমার কোনবন্ধু বান্ধব বাসায় গেলেই বাবা প্রায় লাঠি নিয়ে মারতে আসে। মনে হচ্ছে উনার ব্রেইন শর্ট সার্কিট হয়ে গেছে।
সফিক পরপর দুকাপ চা খেল। সিগারেট ধরাল না। জানলাম সে সিগারেট ছেড়ে দিয়েছে। আজকাল না-কি আর সিগারেটের ধুয়া সহ্য করতে পারছে না।
আমি বললাম, চোখে সানগ্লাস কেন?
সে ক্লান্ত গলায় বলল, আমার প্যাঁচার স্বভাব হয়ে গেছে। চোখে আলো সহ্য হয় না। এজন্যেই চারদিক অন্ধকার করে রাখি। শুনলাম পরপর দুদিন তুই আমরা খোঁজে বাসায় গিয়েছিলি। কারণ কি?
কারণ নেই।
অকারণে তুই আমার খোঁজে যাবি, এটা বিশ্বাসযোগ্য না। কারণটা কি বল।