মা চেঁচিয়ে বললেন, খেতে আসব মানে? তুমি কি জান না আমি রোজা?
না, আমি জানতাম না।
এখন বল–রোজা রাখাও একটা হাস্যকর ব্যাপার।
রূপা তার জবাব না দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, খেতে বস। তুমি না বললে তোমার ক্ষিধে পেয়েছে?
আমি খেতে বসলাম। লক্ষ করলাম রূপা খেতে পারছে না। ভাত মাখাচ্ছে, মুখে তুলতে পারছে না। তার চোখ ভেজা। আমি রূপাকে কখনো কাঁদতে দেখিনি। আজ কি সে কাঁদবে? রূপা কিছু কিছু জিনিস তার মায়ের কাছ থেকে পেয়েছে। কঠিন আঘাতে না কাঁদার স্বভাবও কি তার মায়ের কাছ থেকে পাওয়া?
বাবা খুব সম্ভব প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্যে বললেন, বিরিয়ানী এবং তেহারী এই দুটা জিনিসের মধ্যে ডিফারেন্সটা কি?
আদর্শ মানব বাবু অবাক হয়ে বলল, আমাকে কিছু বলছেন? বিরিয়ানী এবং তেহারী এই দুয়ের মধ্যে ডিফারেন্সটা কি?
আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন? আমি কি বাবুর্চি? আমাকে এমন জিনিস জিজ্ঞেস করবেন যার উত্তর আমি জানি। যেমন ধরুন, আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন–ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স এবং কোয়ান্টাম মেকানিক্স এই দুয়ের মধ্যে প্রভেদ কি তাহলে আমি বলতে পারব। সেটা কি জানতে চান?
বাবা অসম্ভব বিরক্ত হলেন। বাবু তাকাল রূপার দিকে।
ভাবী, তুমি জানতে চাও?
চাই।
সত্যি চাও না কথার কথা?
সত্যি চাই।
ঠিক আছে বলছি। নিউটনের নাম শুনেছ তো ভাবী? নিউটনের গতিসূত্র দিয়ে শুরু করা যাক …
বাবু বক বক করে যাচ্ছে। রূপা মনোযোগী ছাত্রীর মত তাকিয়ে আছে বাবুর দিকে। আমি তাকিয়ে আছি রূপার চোখের দিকে। দেখতে চাচ্ছি তার ভেজা চোখ কি শুকিয়ে যাবে? না কি শেষ পর্যন্ত সে নিজেকে সামলাতে পারবে না? কতটুক শক্ত এই মেয়ে!
খাওয়া শেষ করে ঘরে এসেছি। রূপা পান চিবুতে চিবুতে ঘরে ঢুকল। হাসি মুখে বলল, মা মিষ্টি পান আনিয়েছেন। পান খাবে?
আমি পান নিলাম।
তুমি বিছানায় বস তো। আমি তোমার ইজিচেয়ারটায় বসে দেখি কেমন লাগে।
আমরা জায়গা বদল করলাম। রূপা বলল, তোমাকে বলতে ভুলে গেছি মুনিয়ার হাসবেণ্ড অর্থাৎ এক্স হাসবেও টেলিফোন করেছিলেন। তোমার সঙ্গে তাঁর নকি ভীষণ জরুরী কথা আছে। ঠিকানা দিয়ে দিয়েছেন। দেখা করতে বললেন।
কবে দেখা করতে হবে?
আজ। বিকেলে চলে যেও।
আচ্ছা।
তুমি কি ঘুমুবে? ঘুমুতে চাইলে চাদর গায়ে শুয়ে পড়। আমি ইজিচেয়ারে শুয়ে শুয়ে তোমার দিকে তাকিয়ে থাকি।
ঘুম পাচ্ছে না।
রূপা হাসল। আমি বললাম, হাসছ কেন?
রূপা হাসতে হাসতে বলল, তোমার পড়ুয়া ভাইকে কিছুক্ষণ আগে একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করলাম। সে ধাঁধা শুনে পুরোপুরি ভড়কে গেছে–আমার ধারণা পড়াশোনা বাদ দিয়ে এখন সে এইটা নিয়েই ভাববে।
কি ধাঁধা।
খুব সহজ ধাঁধা। দুজন ছেলেকে তাদের বাবারা কিছু টাকা দিয়েছিলেন। একজন তাঁর ছেলেকে দিলেন ১৫০ টাকা, অন্যজন দিলেন ১০০ টাকা। ছেলে দুজন তাদের টাকা গুনে দেখল একত্রে তাদের টাকা হয়েছে মাত্র ১৫০। কি করে সম্ভব হল? তুমি কি পারবে?
না।
বাবুও পারবে না। কিছু কিছু মানুষ আছে যারা সহজ জিনিসগুলি খুব জটিল ভাবে চিন্তা করে। তাদের পক্ষে এই ধাঁধার উত্তর বের করা অসম্ভব।
আমি বিছানায় শুয়ে পড়লাম।
রূপা তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তার মুখের ভাব সহজ। চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক। যেন কিছুই হয়নি। দুপুরের ঘটনাটা সে মাথা থেকে দূর করে দিয়েছে। রূপা বলল, চা খাবে?
না।
খাও একটু। মতির মাকে চা দিতে বলেছি। সে চা নিয়ে আসবে।
আচ্ছা।
মতির মা চা নিয়ে ঘরে ঢুকল। আমি এবং রূপা চা খাচ্ছি। চা খেতে খেতে রূপা বলল, আমি যখন কোন কথা বলি তখন কি তুমি মন দিয়ে শোন, না শুধু তাকিয়ে থাক?
মন দিয়ে শুনি। সবার কথাই আমি মন দিয়ে শুনি।
তোমার মা আজ ভাত খাবার সময় যে কথাগুলি বলেছিলেন তুমি কি তা মন দিয়ে শুনেছ?
হুঁ।
আমার মা সম্পর্কে তিনি যা বললেন সেগুলি কি তোমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে?
না।
যদি বিশ্বাসযোগ্য মনে না হয়ে থাকে তাহলে কেন তুমি তোমার মাকে চুপ করতে বললে না? আমি যে কি ভয়ংকর লজ্জা পাচ্ছিলাম তা তোমার চোখে পড়ে নি?
চোখে পড়েছে।
তাহলে চুপ করে ছিলে কেন? প্রতিবাদ করনি কেন?
রূপার গলার স্বর বদলে যাচ্ছে। চোখের তারায় অন্য এক ধরনের আলো। সে আজ বিশেষ কিছু বলবে। সেই বিশেষ কথাগুলি শোনার জন্যে আমি অপেক্ষা। করছি। রূপা চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে ঠোঁট মুছল, তারপর আগের চেয়েও নিচু গলায় বলল, প্রতিবাদ আমি নিজেও করতে পারতাম। ভণ্ডামী, ভান এইসব আমার ভাল লাগে না। যেখানে এইসব দেখেছি কঠিন গলায় প্রতিবাদ করেছি। তোমার মার কথার কোন প্রতিবাদ করতে পারলাম না, কারণ তিনি যা বলেছেন সত্যি বলেছেন। এক বিন্দু মিথ্যা নয়।
তাতে কিছু যায় আসে না।
সবটা শোন তারপর বল, তাতে কিছু যায় আসে না। আমার মা আর্ট স্কুলের ছাত্রী ছিলেন। অহংকারী জেদী একটি মেয়ে। অসম্ভব রূপবতী। আমি বলেছি না মার কিছু কিছু জিনিস আমি পেয়েছি। রূপ হচ্ছে তার একটা। কিন্তু মা ছিলেন দরিদ্র। তাদের পুরো পরিবারটাই দরিদ্র। দুবেলা খাবার সামর্থও এই পরিবারের ছিল না। এমন একটা পরিবারে রূপবতী মেয়ে হয়ে জন্মানোর হাজারো সমস্যা। মা আর্ট স্কুলের পড়ার খরচ চালাতে পারেন না। অনাহারের কষ্টও এক সময় অসহ্য বোধ হল। এক সময় দেখা গেল ছুটির দিনে নাইট ক্লাবগুলিতে তিনি নাচতে শুরু করেছেন। বাড়তি কিছু টাকা আসছে।