এখন একটু স্টেবল। ডাক্তাররা বলছেন আউট অব ডেনজার। চা খাবে?
খেতে পারি।
মুখ ধুয়ে এসো। চা আসছে। মুনিয়াকে চা দিতে বলে এসেছি। সে এক্ষুণি আনবে।
রূপা আবার লাবণ্যকে হাসাতে লাগল। তাদের দুজনের মধ্যে কিছু কথাবার্তাও হচ্ছে। কথাবার্তা হচ্ছে সাংকেতিক ভাষায় যার মাথামুণ্ডু আমি কিছুই বুঝলাম না। কথা-বার্তা এ রকম,
রূপা : কিটেমন ইটাছ?
লাবণ্য : ভিটাল ইটাছি।
রূপা : তিটুমি ইটামাকিটে ভিটাল বিটাস?
লাবণ্য : বিটাসি।
আমি ওদের অদ্ভুত ভাষার কথাবার্তা শুনছি। মজাই লাগছে। এই ভাষার ওপর মনে হয় এদের দুজনেরই বেশ দখল। দ্রুত কথা বলে যাচ্ছে। এমন মজার কথাবার্তর মাঝখানে হাসপাতাল থেকে খবর এল ভিখিরী মারা গেছে। রূপা কঁদিতে শুরু করল। হৈচৈ ধরনের কান্না। মা বিস্মিত হয়ে বললেন, বৌমা কাঁদছে কেন?
আমি বললাম, একজন ভিখিরী মারা গেছে তাই কাঁদছে।
তামাশা করছিস নাকি?
না, তামাশা করছি না। শুধু শুধু তামাশা করব কেন?
মা কঠিন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
আজ মাসের প্রথম শুক্রবার
আজ মাসের প্রথম শুক্রবার।
মাসের প্রথম শুক্রবারে মা কিছু এতিম খাওয়ান। বেজোড় সংখ্যক এতিম–তিন, পাঁচ, কিংবা সাত। কোন হাদিসে তিনি পড়েছেন আল্লাহ নিজে যেহেতু বেজোড় তিনি বেজোড় সংখ্যা পছন্দ করেন। বেজোড় সংখ্যার উপর আল্লাহর খাস রহমত।
কাজের ছেলে মাখন গিযেছে এতিমের সন্ধানে। বাসায় তেহারী রান্না হচ্ছে। মা নিজেই রাঁধছেন। বাজারও তিনি নিজেই তাঁর রোজগারের টাকায় করে নিয়ে এসেছেন। কুটা বাছা সব নিজে করবেন। এতিমদের পরিবেশনার দায়িত্বও তাঁর নিজের। সোয়াবের ভাগ অন্য কাউকে দেবেন না। সবটাই তাঁর।
এতিম খাওয়ানোর দিনে আমরা একটু ভয়ে ভয়ে থাকি কারণ মার মেজাজ থাকে খুব খারাপ। তিনি খিদে সহ্য করতে পারেন না, এই দিনে তিনি রোজা রাখেন। বলে মাথা ঠিক থাকে না।
আজ তাঁর মাথা অন্যদিনের চেয়েও খারাপ কারণ কাজের ছেলে খুঁজে পেতে মাত্র দুজন এতিম ধরে এনেছে। বেজোড় আনার কথা, জোড় এনেছে। তাদের খেতে দেয়া হয়নি, বসিয়ে রাখা হয়েছে। মাখন আবারো গেছে। তার ফেরার নাম নেই। আড়াইটা বেজে গেছে। আমাদের খাবার দেয়া হচ্ছে না, কারণ এতিম দুজন অতিথি। এরা খাওয়া শেষ করলে আমরা খাব।
এতিম দুজনের মধ্যে একজন উসখুস করছে। চলে যেতে চাচ্ছে। মনে হয় এ তেমন ক্ষুধার্ত না, কিংবা নিমন্ত্রণ উপেক্ষা করার মত সাহস তার আছে। শূন্য থালা সামনে নিয়ে কতক্ষণ আর বসে থাকা যায়?
পৌনে তিনটায় সাইকেলের পছনে বসিয়ে মাখন তৃতীয় এতিম নিয়ে উপস্থিত হল। মাখনের মুখ ভর্তি হাসি। মা বললেন, একটা এতিম জোগাড় করতে এতক্ষণ লাগল?
মাখন দাঁত বের করে বলল, আসল নকল বিচার কইরা আনা লাগে না? নকল এতিমে ঢাকা ভর্তি।
যেটা এনেছিস সেটা আসল?
বাজাইয়া আনছি আম্মা। আর মা তিনজনকেই বসে বসে খাওয়ালেন। আরেকটু নাও, আরেকটু নাও বলে খাদিমদারি করলেন। খাওয়ার শেষে পান সুপারি এবং তিনটা করে টাকা দেয়া হল। মা আনন্দিত মনে ঘরে ঢুকলেন। আর তখনি রূপার সঙ্গে তাঁর বড় ধরনের ঝামেলা বেঁধে গেল। ঝামেলার শুরুটা আমি জানি না। বাথরুমে ছিলাম, শুনতে পাইনি। যা শুনলাম তা হল–মা রাগী গলায় বলছেন,
তোমার ধারণা আমার এই এতিম খাওয়ানো ব্যাপারটা হাস্যকর?
দ্ধি মা, আমার তাই ধারণা। খুব হাস্যকর।
দরিদ্র ক্ষুধার্ত মানুষকে ভরপেট খাওয়ানো তোমার কাছে হাস্যকর?
যে ভঙ্গিমায় খাওয়াচ্ছেন তা হাস্যকর। আয়োজনটা হাস্যকর। কেন?
ক্ষুধার্ত মানুষ, ভিখিরী এদের জন্যে আপনার আসলে তেমন কোন মমতা নেই। এতিম খাওয়ানো উপলক্ষে হৈ চৈ করতে পারছেন–এটাই আসল।
এই বয়সে আসল নকল জেনে বসে আছ? দুদিনের মেয়ে, আমার ভুল ধরতে আস? নিজের ভুলগুলি চোখে পড়ে না?
রূপা শান্তগলায় বলল, আমার কি ভুল মা?
এর উত্তরে মা কিছু ভয়ংকর কথা বলে ফেললেন। তাঁকে ঠিক দোষ দেয়া যায় না। সারাদিনের পরিশ্রমে এবং উপবাসে তাঁর মাথায় রক্ত চড়ে গেছে। তাছাড়া এই কঠিন কথাগুলি তাঁর মনে ছিল। বলার মত পরিস্থিতি হয় নি। কে জানে মা হয়ত এই পরিস্থিতিকেই কাজে লাগালেন। প্রতিটি মেয়েই নিষ্ঠুর হবার অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। মা বললেন, তোমার ভুল আমাকে বলে দিতে হবে? তুমি নিজে তা জান না? সিনেমা করার নামে রাজ্যের পুরুষদের সঙ্গে যে মাখামাখিটা কর তা তুমি নিজে জান না? নাকি নিজের অজান্তে কর? আর করবে নাই বা কেন? রক্তের টান আছে না? মার কাছ থেকেই তো শিখেছ? তোমার মাও তো ক্লাবে ক্লাবে নেচে বেড়াতে। কোন ধরনের মেয়ে ক্লাবে ক্লাবে নেচে বেড়ায় তা কি আমি জানি না? নাকি তুমি ভেবেছ আমিও রঞ্জুর মত গাধা?
রূপ৷ ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
আমি বিস্মিত হয়ে ঘরে উপস্থিত অন্য মানুষগুলির দিকে তাকালাম। কেউ কিছু বলছে না। কেউ মাকে থামাবার চেষ্টা করছে না। বাবা এমন ভাব করছেন যেন তিনি কিছুই শুনতে পান নি। মুনিয়া তার মেয়ের মুখে তেহারী তুলে দেয়ায় অতিরিক্ত রকমের ব্যস্ত। আদর্শ মানব বাবু একমনে খেয়ে যাচ্ছে। আমার ধারণা মায়ের কোন কথাই তার কানে ঢুকে নি। তার প্লেটের কাছে একটা বই খোলা। তার সমস্ত ইন্দ্রিয় বই—এ নিবদ্ধ। আগামীকাল থেকে তার পরীক্ষা শুরু।
রূপা বলল, আপনি ঠিকই বলেছেন, কিছু কিছু জিনিস আমি আমার মায়ের কাছ থেকে পেয়েছি। আপনাকে রাগিয়ে দেবার জন্যে দুঃখিত। আসুন, খেতে আসুন।