ভাবীর সংগে আমার খুব কথা বলার শখ। একদিন যদি কথা বলার জন্যে আপনাদের বাসায় যাই উনি কি রাগ করবেন?
ও রাগ করতে পারে না। তবে মানুষদের খুব সহজে রাগিয়ে দিতে পারে। আচ্ছা সুমি যাই। তোর মনে হয় দেরি হয়ে যাচ্ছে।
আবার কবে আসবেন?
দেখি। এমন খারাপ করে সেজেছিস কেন? কুৎসিত লাগছে। তোকে তেলাপোকার মতো লাগছে।
সুমি রাগ করল না। হাসল। সুমির সংগে এই একটা দিকে রূপার মিল আছে। রূপার মতো সেও রাগ করে না। আমি অনেকবার চেষ্টা করে দেখেছি। রাগাতে গেলে হাসে।
যাই সুমি?
আচ্ছা যান। চা খাওয়াতে পারলাম না, কিছু মনে করবেন না।
তোকে কুৎসিত লাগছে এটা ঠিক না, ভালোই লাগছে। ঠাট্টা করে বলেছিলাম।
সুমি চুপ করে রইল। আর অপেক্ষা করার কোনো মানে হয় না। নাটকীয় ভঙ্গিতে অবশ্যি বলতে পারি, বিয়ে কোথায় হচ্ছে আমাকেও নিয়ে চল। বিয়ে বাড়িতে যতো বেশি লোক নিয়ে যাওয়া যায় ততোই ভাল। একজনকে দাওয়াত করলে পুরো ফ্যামিলী নিয়ে যেতে হয়। যিনি দাওয়াত করেছেন তাঁর যেন আক্কেল গুড়ুম হয়ে যায়। আমি সিগারেট ধরাতে ধরতে বললাম, সুমি।
জ্বি।
আমাকেও সংগে নিয়ে চল্। অনেকদিন বিয়ে খাওয়া হচ্ছে না।
আপনার কি মাথাটা খারাপ হয়ে গেল? বাসায় যান তো।
আচ্ছা যাচ্ছি, কথা বলে যতো সময় নষ্ট করলি এর মধ্যে এক কাপ চা খাইয়ে ফেলতে পারতিস।
বসুন তা হলে। দেখি ব্যবস্থা করা যায় কি-না। আমাদের অবশ্যি এম্নিতেও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। বাবা এখনো ফিরেন নি। উনি ফিরলেই রওনা হব।
আমি বসলাম।
বসার ঘরটাকে এরা মোটামুটি আস্তাবল বানিয়ে রেখেছে। বিশাল এক খাট পাতা। খাটের উপর ময়লা তোষক। কোন চাদর নেই। কেউ বোধহয় সকালে মুড়ি খেয়েছে। তোষকে এবং মেঝেতে মুড়ি পড়ে আছে। মেঝেতে তিন জায়গায় খবরের কাগজের তিনটা পাতা। টেবিল একটা আছে। সেই টেবিলে আধ খাওয়া চায়ের কাপে ভন ভন করে মাছি উড়ছে। রাতের বেলা মাছি উড়ার কথা না, কিন্তু এ বাড়িতে উড়ছে।
চায়ের জন্যে অপেক্ষা করতে করতেই সুমির বাবা এসে পড়লেন। এই কয়েকদিনে তিনি আরো বুড়ো হয়ে পড়েছেন। তাঁর আরেকটা দাঁত পড়ে গেছে। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বললেন, কে?
জ্বি আমি, আমার নাম রঞ্জু।
কোন রঞ্জু?
সফিকের বন্ধু।
ও আচ্ছ, সফিকের বন্ধু। হারামজাদা আছে কোথায় তুমি জান?
জ্বি-না।
দেখা হবে তার সাথে?
বুঝতে পারছি না।
দেখা হলে বলবে বাসায় যেন না আসে। বাসায় এলে জুতিয়ে হারামজাদার আমি …
সফিক কি নতুন কিছু করেছে?
বই লিখেছে জান না?
শুনেছি।
সেই মহান সাহিত্য আবার আমাকে উৎসর্গ করা হয়েছে। লেখা—আমার পরম পূজনীয় বাবাকে … আরে ছাগল, বাপের উপর ভক্তিতে গলে যাচ্ছিস। বাপ সংসার টানতে টানতে ভারবাহী পশু হয়ে গেছে সেদিকে খেয়াল নেই? তোকে ডাক্তার বানাতে গিয়ে যে পথের ফকির হয়েছি সেদিকে খেয়াল আছে রে হারামজাদা? চাকরি পেয়েছে, চাকরি করবে না। সাহিত্য করবে। করাচ্ছি তোমাকে সাহিত্য। জুতিয়ে আমি তোমার হাড়ি ভেঙ্গে দেব। সাহিত্য কত প্রকার ও কি কি হাড়ে হাড়ে বুঝবে।
উনি ভেতরে ঢুকে গেলেন। সুমি চায়ের কাপ হাতে ঢুকল এবং বলল, খুব তাড়াতাড়ি চা খেয়ে চলে যান। বাবার মেজাজ আকাশে উঠে গেছে। বিয়ের উপহার কিনতে গিয়েছিলেন, পকেটমার হয়েছে।
তোদের তাহলে আর বিয়েতে যাওয়া হচ্ছে না।
মনে হয় না।
বাসায় ফিরলাম রাত সাড়ে এগারোটায়। রূপা ফেরেনি। লাবণ্যও ফেরে নি। মুনিয়া একবার ফিট হয়েছে। তার মাথায় বর্তমানে পানি ঢালা হচ্ছে।
লাবণ্যর বাবার মামা, যিনি নারায়নগঞ্জের মোজা কারখানার ম্যানেজার তাঁর ঠিকানা পাওয়া গেছে। বাবুকে বলা হচ্ছে সেখানে গিয়ে লাবণ্যর বাবার ঠিকানা জোগাড় করতে। বাবু বিস্মিত। এরকম অদ্ভুত প্রস্তাব কেউ যে তাকে করতে পারে তাই সে ভাবতে পারছে না।
আমাকে নারায়ণগঞ্জে যেতে বলছ?
মুনিয়া ক্ষীণ স্বরে বলল, হ্যাঁ।
দশ দিন পর আমার পরীক্ষা শুরু হচ্ছে, এখন আমি যাব নারায়ণগঞ্জ?
হ্যাঁ।
ফাজলামী কথা আমার সঙ্গে না বললে ভাল হয়।
মুনিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমার মেয়ের কোন খোঁজ নেই এটা কি কোন ফাজলামী কথা?
আমাকে যে নারায়ণগঞ্জ যেতে বলা হচ্ছে এটাই ফাজলামী কথা, কারণ। নারয়ণগঞ্জ কোথায় তাই আমি জানি না।
আমি বললাম, কোন সমস্যা নেই, আমি যাব নারায়ণগঞ্জ। মুনিয়া, তুই কান্নাকাটি বন্ধ কর তো। যা ভাত আন। আমি ভাত খেয়েই রওনা হব।
ভাত খেতে গেলে দেরি হয়ে যাবে।
আচ্ছা, ভাত খাব না, ভাল করে এক কাপ চা বানিয়ে আন। চা খেয়ে রওনা দি।
নারায়ণগঞ্জ যেতে হল না। লাবণ্যর বাবা টেলিফোন করলেন। জানা গেল বিশেষ কাজে আটকা পড়েছেন বলে তিনি লাবণ্যকে দিয়ে যেতে পারেন নি। ভোরবেলা নিয়ে আসবেন। মুনিয়ার মুখে হাসি ফিরে এল।
রাত একটার মতো বাজে।
আমি বারান্দায় অলস ভঙ্গিতে হাঁটাহাঁটি করছি। ভাব করছি যেন কিছুই হয়নি। ভাবুক ধরনের একজন মানুষ ঘুমুবার আগে নৈশ ভ্রমণের একটা অংশ সারছেন। ভঙ্গিটাকে আরো জোরদার করার জন্য গুনগুন করে গান গাওয়া যায় কিংবা শিস দেয়া যায়–অবশ্যি তার এখন প্রয়োজন নেই। কেউ আমাকে লক্ষ্য করছে না। বাড়ি নিঝুম। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে।
কোনো কিছু চিন্তা না করে মানুষ কি হাঁটাহাঁটি করতে পারে? একটা মানুষ হেঁটে যাবে কিছুই ভাববে না। তার মাথা থাকবে ফাঁকা, আমার মনে হয় এটা খুবই অসম্ভব একটা ব্যাপার। মানুষ সারাক্ষণই ভাবে। তার মস্তিষ্ক কখনো বিশ্রাম নেয়। না। মস্তিষ্কের বিশ্রাম গ্রহণের কোনো ক্ষমতা নেই।