মুনিয়া উঠে চলে গেল।
আমি অলস ভঙ্গিতে সফিকের উপন্যাসের পাতা উল্টাচ্ছি। আমারো কিছু করার নেই। রূপা খুব ভোরবেলায় সেজেগুজে বের হয়ে গেছে। কোথায় যাচ্ছে জিজ্ঞেস করি নি। সেও কিছু বলেনি। শুধু ঘর থেকে বেরুবার সময় বলল, দুদিন ধরে তুমি দাড়ি গোফ কামাচ্ছ না। তোমাকে দেখাচ্ছে ব্যর্থ প্রেমিকের মত। আজ ফিরে এসে যেন তোমাকে ক্লীন শেভড় দেখতে পাই।
এই পর্যায়ে আমি খুব সহজেই বলতে পারতাম, কখন ফিরবে?
বলিনি। বলতে ইচ্ছা করল না।
রূপা যখন ঘরে থাকে না তখন আমারো ঘরে থাকতে ইচ্ছা করে না। তারপরেও আজ সারাদিন ঘরেই ছিলাম। এখন আর ঘরে থাকতে ইচ্ছা করছে না। সফিকের উপন্যাসের নায়কের মত রাস্তায় নেমে পড়তে ইচ্ছা করছে। সাইকেল থাকলে ভাল হত। সাইকেলে করে ঘুরতাম। সফিকের উপন্যাসের নায়ক লোকমান রাতের বেলা সাইকেলে করে ঘুরে এবং মাঝে মাঝে সাইকেলের সঙ্গে গল্প করে। সাধারণত সাইকেলের সঙ্গে আলাপ আলোচনা খুব দার্শনিক ধরনের হয়। যেমন নায়ক বলল, পথের শেষ কোথায়?
সাইকেল টুনটুন করে ঘণ্টা বাজিয়ে ঘণ্টাতেই উত্তর দিল, পথের শুরুতেই হচ্ছে পথের শেষ।
তার মানে কি?
মানে খুব সহজ। শুরুই শেষ। আবার শেষই শুরু।
বুঝতে পারছি না।
বুঝতে না পারার কিছু নেই। পথ হচ্ছে জীবনের মত। জীবনের শেষ হচ্ছে জীবনের শুরুতে। পথের বেলাতেও তাই।
তাহলে ভালবাসার শেষ কোথায়?
ভালবাসার শেষ হচ্ছে ঘৃণার শুরুতে …।
লোকমান সাহেব এবং সাইকেলের কথাবার্তার এই হচ্ছে সামান্য নমুনা। উপন্যাস যত এগুতে থাকে কথাবার্তা ততই জটিল হতে থাকে। এমন দার্শনিক ধরনের সাইকেল লোকমান কোথায় পেয়েছে কে জানে।
আমি কাপড় পাল্টালাম। ঠিক করলাম রাত এগারোটা পর্যন্ত বাইরে থাকব। বাসায় ফিরে এসে যেন দেখি লাবণ্য ফিরেছে, রূপাও ফিরেছে। মুনিয়া শান্ত হয়েছে।
বাড়ি থেকে বের হবার আগে বাবার ঘরে উঁকি দিলাম। বাবা অবেলায় বিছনায় শুয়ে আছেন। তিনি আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন, কে?
বাবা আমি রঞ্জু।
কি ব্যাপার?
আপনার কাছে কি হাজার তিনেক টাকা হবে?
কি জন্যে? আমার একটু দরকার ছিল, ব্যক্তিগত প্রয়োজন।
আমার টাকা তোমার ব্যক্তিগত প্রয়োজন মেটানোর জন্যে তা মনে করার কোন। কারণ দেখছি না।
ও আচ্ছা, তাহলে থাক।
প্রয়োজনটা কি?
ভাবছি একটা সাইকেল কিনব।
বাবা বিছানায় উঠে বসলেন। তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, কি বললে?
একটা সাইকেল কিনব।
হোয়াই?
রাতে রাস্তায় ট্রাফিক কম থাকে। তখন সাইকেলে করে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরব।
কেন?
রাতের বেলা সাইকেলে করে ঘুরে বেড়ানো খুন ইন্টারেস্টিং।
তোমাকে কে বলেছে?
লোকমান।
লোকমানটা কে?
সফিক একটা উপন্যাস লিখেছে তার নায়ক।
তুমি সামনের চেয়ারটায় বস।
আমি বসলাম। বুঝতে পারছি বাবা নিজেকে গুছিয়ে নিতে সময় নিচ্ছেন। কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না।
রঞ্জু।
জ্বি।
তোমার ব্যাপার আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। এইসব কি বলছ? বাবুর কাণ্ডকারখানারও কোন আগা মাথা পাচ্ছি না–সে দেখি বারান্দায় ক্যাম্পখাটে ঘুমুচ্ছে। তাকে বললাম, কি ব্যাপার? সে বলল, চিলেকোঠার ঘরে তার নাকি একা ঘুমুতে ভয় লাগে। ভূতের উপদ্রপ।
আমি সহজ গলায় বললাম, একটা ভূত তাকে খুব বিরক্ত করছে। ঘুমুলেই কড়া নেড়ে ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেয়। এ জন্যেই বারান্দায় ঘুমুচ্ছে। বারান্দায় তো আর কড়া নাড়ার কোন ব্যবস্থা নেই।
বাবা অনেকক্ষণ এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, আচ্ছা তুমি যাও। তিন হাজার টাকা আমি তোমাকে দেব। এখন দিতে পারছি না। ব্যাংক থেকে তুলতে হবে। লোকমানের মত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়।
লোকমানের মত আমি ঘণ্টাখানিক রাস্তায় হাঁটলাম। তারপর গেলাম সফিকের খোঁজে।
যথারীতি সফিক নেই। তার বোন সুমি বিস্মিত হয়ে বললো, আপনি? আপনি কোখেকে?
আমি বললাম, যাচ্ছিলাম এইদিক দিয়ে। ভাবলাম, দেখি সফিক আছে কি-না। তার বইটা পড়া ধরেছি। দশপাতা পড়েছি।
এক সপ্তাহে মাত্র দশপাতা?
ধীরে ধীরে পড়ছি। আমি তোদের মতো দ্রুত পড়তে পারি না। চা খাওয়াতে পারিস? বিকেলে চা খাওয়া হয়নি।
এখন তো চা খাওয়াতে পারবো না। আমরা সব বিয়েবাড়িতে যাচ্ছি। এম্নিতেই আমাদের দেরি হয়ে গেছে।
ও আচ্ছা। আমি ভেবেছিলাম খানিকক্ষণ তোর সঙ্গে গল্প করবো।
সুমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কি একটা বলতে গিয়েও বলল না। সে বিয়েবাড়ি উপলক্ষে সাজসজ্জা করেছে। কিছু কিছু মেয়ে আছে যাদের সাজলে খারাপ দেখায়। সুমি তাদের একজন। তাকে রীতিমতো কুৎসিত দেখাচ্ছে।
সুমি বলল, আপনি কি বিশেষ কোনো প্রসঙ্গে আলাপ করতে চান?
হ্যাঁ।
আজ না। অন্য আরেকদিন আসুন। অবশ্যি আমার মনে হয় না আপনি আলাপ করতে চান। আপনি কথার কথা বলেছেন। কেউ যখন কথার কথা বলে তখন সেটা বোঝা যায়। আচ্ছা আপনার কি কোনো কারণে মনটন খারাপ?
না তো।
আপনাকে কেমন যেন অসুস্থ অসুস্থ লাগছে। আপনি বাসায় চলে যান। বাসায় গিয়ে আরাম করে ঘুমান। ভাবী কেমন আছেন?
ভালো।
ভাবী সিনেমা করছেন এটা কি সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি।
আচ্ছা, উনি না-কি অসম্ভব রূপবতী। ভাইয়া বলছিল হেলেন অব ট্রয় তাঁকে দেখলে অপমানে গলায় দড়ি দিত। সত্যি?
সেটা হেলেন অব ট্রয়কে জিজ্ঞেস করাটাই কি উচিত না?
উনাকে তো পাচ্ছি না। তাই আপনাকে জিজ্ঞেস করছি।
হেলেন অব ট্রয় খুব সম্ভব ভুরু কুঁচকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকবে। মেয়েরা সহজে গলায় দড়ি দেয় না।