রঞ্জু।
জ্বী।
আজ রাতে তোমার সঙ্গে যেসব কথা বলেছি তার জন্যে আমি দুঃখিত। এবং খানিকটা লজ্জিত।
দুঃখিত এবং লজ্জিত হবার কিছু নেই বাবা। আপনি যা বলেছেন ঠিকই বলেছেন।
না ঠিক বলিনি। তোমার উপর অবিচার করা হয়েছে। আই এ্যাম সরি। চেয়ারটায় বস।
আমি বসলাম। বাবা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন, তোমার প্রতি আমার যে বিশেষ এক ধরনের দুর্বলতা আছে তা-কি তুমি জান?
জানি।
না তুমি জান না। তবে তোমার জানা থাকা প্রয়োজন। জানলে পিতা-পুত্রের সম্পর্ক সহজ হবে।
আমাদের সম্পর্ক সহজই আছে।
সম্পর্ক সহজ নেই, তা আমি যেমন জানি তুমিও জান। তোমার প্রতি আমার বিশেষ দুর্বলতার কারণ বলি। তোমার জন্মের এক মাস পরের ঘটনা। আমি তোমাকে কোলে নিয়ে হাঁটছি। ছোট বাচ্চা কোলে নিয়ে হাঁটার অভ্যাস নেই। হঠাৎ কি যে হল তুমি আমার কোল থেকে নিচে পড়ে গেলে।
এই ঘটনা আমি জানি, অনেকবার শুনেছি।
না শোনার কোন কারণ নেই। এটা একটা ভয়াবহ ঘটনা। তোমার জীবন সংশয় হয়েছিল। এরপর থেকে তুমি যখন উদ্ভট কিছু কর আমি নিজেকেই দোষ দেই। তোমাকে দেই না। তোমার বিচিত্র কাণ্ড কারখানার জন্যে নিজেকে দায়ী করি। আমার মনে হয় মাথায় আঘাত পাওয়ার ফলে তোমার বুদ্ধিবৃত্তি ঠিকমত বিকশিত হয়নি। এর ফল খুব শুভ হয় নি। তুমি ভয়বাহ ধরনের প্রশ্রয় পেয়েছ। প্রশ্রয়ের ফল কখনো শুভ হয় না। আমার কথা তো শুনলে—এখন তোমার কি কিছু বলার আছে?
আছে।
বল, আমি শুনব। খুব পেশেন্ট হিয়ারিং দেব।
আমি সহজ গলায় বললাম, বাবা, আপনি কি আমাকে এক কাপ চা বানিয়ে খাওয়াবেন?
জাজ সাহেব বাবা হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি তাকিয়ে রইলাম সজনে গাছটার দিকে। গাছটা মরে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে মরছে।
মুনিয়ার ঘর থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। মা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে কি সব যেন বলছেন। লাবণ্যও জেগে উঠেছে। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে–মামীর ঘরে যাব। মামীর ঘরে যাব।
ছাদের সিঁড়িতে খটখট শব্দ করতে করতে বাবু নেমে এল। তার চোখে মুখে চাপা আতংক। সে আমার দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ গলায় বলল, দাদা, তুমি কি আমার ঘরের দরজায় কড়া নেড়েছ?
কখন?
এই ধর পাঁচ মিনিট আগে?
না।
বাবু চোখ বড় বড় করে বলল, দাদা, একটু আস তো আমার ঘরে।
বাবাকে ইজিচেয়ারে রেখে আমি বাবুর সঙ্গে ছাদে উঠে গেলাম। বাবু বলল, ঘুমুচ্ছিলাম বুঝলে, কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভাঙ্গল। আমি বললাম, কে? কোন উত্তর নেই। আবার কড়া নাড়া। দরজা খুলে দেখি কেউ নেই। ব্যাপার কি বল তো?
আমি শান্ত স্বরে বললাম, ভূত বলেই তো মনে হচ্ছে।
ভূত মানে? কি বলছ তুমি! ভূত আবার কি?
ভূত হচ্ছে অশরিরী আত্মা। তোদের ফিজিক্স কি ভূত স্বীকার করে না?
দাদা তুমি আমার সামনে থেকে যাও। উদ্ভট সব কথাবার্তা … ভূত! আমি কি কচি খোকা?
আমি বললাম, তুই এক কাজ কর, বাতি নিভিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে থাক–ভূত হলে আবার কড়া নাড়বে। ওর নিশ্চয়ই ব্যক্তিগত কোন সমস্যা আছে। তোর সঙ্গে ডিসকাস করতে চায়।
দাদা তুমি নিচে যাও। তোমাকে বলাই ভুল হয়েছে।
আমি আমার ঘরে ঢুকে দেখি–রূপাও জেগে আছে। রাত তিনটা। এই সময়ে বাড়ির প্রতিটি মানুষ জেগে–ব্যাপারটা আমার কাছে খুব ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে।
লাব্যণকে তার বাবা নিয়ে গেছে
লাব্যণকে তার বাবা নিয়ে গেছে। এক ঘণ্টার মধ্যে ফেরত দিয়ে যাবার কথা। ফেরত দেয়নি। চার ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। দুপুর একটার সময় নিয়েছে–এখন বাজছে পাঁচটা। শীতের সময় পাঁচটাতেই চারদিক অন্ধকার। মুনিয়ার মাথা খারাপের মত হয়ে গেছে। আমি বললাম, চোর ডাকাত তো মেয়েকে নেয়নি। মেয়ের বাবা নিয়ে গেছে। ফিরতে দেরি হচ্ছে। হয়ত ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়েছে।
মুনিয়া তীক্ষ্ণ গলায় বলল, ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়লে তিন ঘণ্টা লাগবে?
তাহলে অন্য কোন ব্যাপার। তারা হয়ত ঠিক করেছে রাতে এক সঙ্গে ডিনার করবে। কোন একটা চায়নিজ রেস্টুরেন্টে …
চুপ কর। আমাকে না বলে চায়নিজ রেস্টুরেন্টে নেবে? মেয়ে তার না আমার?
দু জনেরই, ফিফটি ফিফটি।
আমি নমাস পেটে ধরলাম আর মেয়ে দুজনের ফিফটি ফিফটি?
অনুচিত ধরনের ভাগভাগি তো বটেই। অনুচিত হলেও কিছু করার নেই–সমাজ ঠিক করে দিয়েছে।
মুনিয়া এমন ভাবে তাকাচ্ছে যেন আমিই সেই সমাজ। এক্ষুণি সে ঝাপিয়ে পড়বে আমার উপর। তাকে দেখাচ্ছে বাঘিনীর মত। আমি বললাম, তুই আমার দিকে এভাবে তাকাচ্ছিস কেন? সমাজের নিয়ম কানুন তো আমার তৈরি না।
দাদা, তুই ওর খোঁজ নিয়ে আয়।
কোখেকে খোঁজ আনব? বাসায় যাব? তুই যেভাবে তাকাচ্ছিস তাতে মনে হয় বাসায় যাওয়াই উচিত। ঠিকানা দে; যাচ্ছি।
ঠিকানা জানি না।
টেলিফোন নাম্বার?
মুনিয়া কোন কথা বলল না। দেখা গেল সে টেলিফোন নাম্বারও জানে না। আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, টেলিফোন নাম্বার, ঠিকানা তুই কিছুই জানিস না?
ঐ পিশাচটার ঠিকানা আমি রাখব কেন?
তা তো বটেই। তার কোন আত্মীয়স্বজনের ঠিকানা আছে? সেখান থেকে পিশাচ সাহেবের ঠিকানা বের করার একটা চেষ্টা চালানো যেতে পারে।
কারো ঠিকানাই আমি জানি না। ওর এক মামা থাকে নারায়ণগঞ্জে। কোথায় জানি না। মোজা কারখানার ম্যানেজার।
আমি বললাম, এই ক্ষেত্রে কিছুই করার নেই। রাত আটটা পর্যন্ত অপেক্ষা কর। এর মধ্যে এসে পড়বে। পিশাচ সাহেব নতুন সংসার পেতেছেন। এর মধ্যে একটা মেয়ে নিয়ে ঢুকাবেন না। ঢুকালে তাঁরই যন্ত্রণা। মেয়েকে তোর কাছেই দিয়ে যাবেন। অপেক্ষা করতে থাক।