এক সময় মুনিয়ার বারান্দায় ফুলের টব বসিয়ে একটা কাণ্ড করতে চেয়েছিল। গোলাপের টব, অর্কিডের টব, এমন কি কাজী পেয়ারার টব। এখন মুনিয়ার টবপ্রীতি দূর হয়েছে। টব আছে, গাছ নেই। বর্তমানে বারান্দা হল আমাদের ডাম্পিং গ্রাউণ্ড। যাবতীয় অপ্রয়োজনীয় আসবাব এখানে ডাম্প করা হয়। শুধু আসবাব না, কিছু অপ্রয়োজনীয় মানুষও আমরা বারান্দায় রাখি। এই মুহূর্তে বারান্দার শেষ মাথায় ক্যাম্প খাটে একজন অপ্রয়োজনীয় মানুষ শুয়ে আছেন। তিনি এসেছেন দেশের বাড়ি কেন্দুয়া থেকে। মামলার তদবিরে। ভদ্রলোকের নাম রইসুদ্দিন। আমাদের অতি দূর সম্পর্কের আত্মীয়। কিন্তু কথাবার্তা শুনে মনে হয় আমাদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তাঁকে যে আমরা বারান্দায় ফেলে রেখে অপমান করার চেষ্টা করছি, এটা তিনি বুঝেও না বোঝার ভান করেন। রইসুদ্দিন চাচা আমাকে দেখেই উঠে বসলেন। ছোট-খাটো মানুষ। মামলা মোকদ্দমা করে যেন আরো ছোট হয়ে গেছেন। গালভর্তি কাঁচা-পাকা দাড়ি না থাকলে তাঁকে বাচ্চা ছেলের মতোই লাগত। তিনি হাসিমুখে বললেন, আব্বাজীর ঘুম ভাঙল?
তিনি আমাকে ডাকেন আব্বাজী, আমার বোন মুনিয়াকে আম্মা এবং রূপাকে ডাকেন আম্মাজী। আমার সবচে ছোট ভাই বাবুকে শুধু নাম ধরে ডাকেন। তার বেলায় এই ব্যতিক্রম কেন কে জানে। কারণ একটা নিশ্চয়ই আছে। রইসুদ্দিন চাচার মতো ধুরন্ধর লোক বিনা কারণে কিছু করবেন না। এঁরা প্রতিটি কাজকর্ম। ভেবে-চিন্তে করেন।
তিনি আগের প্রশ্নই আবার করলেন। এবারে মুখের হাসি আগের চেয়েও বিস্তৃত হল।
আব্বাজীর ঘুম ভাঙল?
জ্বী।
ঘুম হইছে কেমন?
ঘুম হইছে কেমন?
ভাল।
আমারো ঘুম ভাল হইছে। ফুরফুরা বাতাস। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব। কম্বল গায়ে দিয়ে লম্বা ঘুম দিলাম। শেষরাতে একটা স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্ন দেখার পর মনটা আরো ভাল হয়ে গেছে। বড়ই মধুর স্বপ্ন।
কেউ স্বপ্নের কথা বললে কি স্বপ্ন দেখা হয়েছে জানতে চাওয়াটা সাধারণ ভদতা। এই মানুষটার সঙ্গে ভদ্রতা করতে আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা করছে না। তবু অভ্যাসের বসে বললাম, কি স্বপ্ন দেখলেন?
দেখলাম শাদা একটা সাপ। গ্রামদেশে এই সাপরে বলে দুধরাজ। এই সাপ আমার হাঁটুতে একটা ছোবল দিল। বিষ যা ছিল সব ঢেলে দিল।
মানুষের কথা শুনে আমি কখনো বিস্মিত হই না। বিশেষ করে এইসব ধুরন্ধর মানুষ কথাবার্তায় সবসময় অন্যদের চমৎকৃত করতে চেষ্টা করে। আমি বুঝতে পারছি রইসুদ্দিন চাচা কথাবার্তায় আমাকে কিছুক্ষণ আটকে রাখার চেষ্টা করছেন। তিনি হয়তো ভাবছেন আমি অবাক হয়ে বলব এরকম ভয়াবহ একটা স্বপ্ন দেখে আপনার মনটা খুশি হয়ে গেল কেন? তার উত্তরে তিনি আরো চমকপ্রদ কিছু বলবেন। আমি তাঁকে সেই সুযোগ দিলাম না। সিঁড়ি দিয়ে একতলায় নেমে গেলাম। সাপ কামড় দিয়েছে এই স্বপ্ন দেখে কেউ যদি আনন্দে আত্মহারা হয়—হোক। মুখে আবার থুথু জমেছে। এ তো বড় যন্ত্রণা হল!
রান্নাঘরে মুনিয়া ছাঁকনি দিয়ে অর্জুন গাছের রস ছাঁকছে। বাবার কবিরাজী ওষুধ। তাঁর হার্টের কি সব সমস্যা। কবিরাজ বলেছে অর্জুন গাছের ছাল সেদ্ধ করে সেই রস খেতে। অর্জুন গাছের সব ছাল নয়। গাছের পুবদিকের ছাল, যেখানে সূর্যের প্রথম রশ্মি পড়ে। মাখন বলে আমাদের যে কাজের ছেলেটি আছে, তার কাজই হচ্ছে সাইকেলে করে দূর-দূরান্ত থেকে অর্জুন গাছের ছাল নিয়ে আসা। মাখনের কোনো কাজে উৎসাহ নেই। এই কাজটিতে খুব উৎসাহ। সে ঢাকা শহরের আশেপাশের সব অর্জুন গাছের ছাল ছাড়িয়ে ফেলেছে বলে আমার ধারণা। ছালছাড়ানো অর্জুন গাছ দেখতে কেমন হয়? মাখনার সঙ্গে একদিন দেখে আসতে হবে।
মুনিয়াকে কেমন যেন অন্যমনস্ক মনে হচ্ছে। মুখ শুকনো। চোখের নিচে কালি। মন হয়তো খারাপ। এটা কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার না। মুনিয়ার মন বেশির ভাগ সময়ই খারাপ থাকে। বছর দুই হল স্বামীর সঙ্গে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। ভদ্রলোক আবার বিয়ে করেছেন। স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকা শহরেই থাকেন। তাদের সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে এই ভয়ে মুনিয়া ঘর থেকে বের হয় না। ঘরে থেকে থেকে বেচারি ফর্সা হয়ে গেছে।
মুনিয়া অর্জুন গাছের রস ছাঁকতে ছাঁকতে রোবটদের মতো গলায় বলল, ভাবীর ঘুম এখনো ভাঙেনি?
না। তোকে কফি আর একটা মাখন লাগানো ক্র্যাকার পাঠাতে বলেছে। কফিতে তিন চামচ চিনি। দু চামচ উচু করে আর এক চামচ সমান সমান।
আর কিছু?
ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি। আইস কোল্ড।
মুনিয়া মুখ টিপে হাসল। আমিও হাসলাম। মুনিয়া আমার পিঠাপিঠি। ওর সংঙ্গে আমার সহজ সম্পর্কের একটা ব্যাপার আছে। আমি ওর সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বললাম, মন খারাপ না কি রে?
মুনিয়া হালকা গলায় বলল, বাসিমুখে আমার সামনে বসিস না। দেখেই বমি বমি লাগছে।
আমি নড়লাম না। গলার স্বর অনেকটা নামিয়ে বললাম, আজ একটা দারুণ ডিসিশান নিলাম।
কি ডিসিশান?
একটা খুন করব।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, এটা হবে একটা পারফেক্ট মার্ডার। কেউ বুঝতেও পারবে না খুন হয়েছে।
মুনিয়া মোটেও বিস্মিত হল না। সে যে বিস্মিত হবে না আমি জানতাম। সে ভাবছে আমি রসিকতা করছি। এটা ভাবাই যুক্তিযুক্ত। যে খুন করবে সে সবাইকে বলে বেড়াবে না।
কাকে খুন করবি কিছু ঠিক করেছিস?
হ্যাঁ, সব ঠিক করা আছে।
আমার কাছে সাজেশান চাইলে দিতে পারি।
কি সাজেশান?
রইসুদ্দিন চাচাকে খুন করে ফেল।
মুনিয়া কথা শেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। সে আশা করছে আমি বলব, রইসুদ্দিন চাচা কি করেছে?