খুব ভাল করেছিস। কোনো বুদ্ধিমান লোক সাহিত্য সভায় যায় না। আচ্ছা, সুমি, আমি যাই। প্রধান অতিথি সাহেবকে বলিস আমি এসেছিলাম।
এক সেকেণ্ডে দাঁড়ান। দাদার একটা নতুন বই বের হয়েছে। বইটা নিয়ে যান।
বই বেরিয়েছে মানে! ও বই লিখল কবে?
বিয়ের পর তো আপনি নিবাসিত জীবন যাপন করছেন—ভাইয়া বই লিখে ছাপিয়ে ফেলেছে। বারোশ কপি ছাপিয়েছে। বন্ধুবান্ধবকে ধরে ধরে জোর করে বই কেনাচ্ছে। আপনার কাছে কি চল্লিশ টাকা আছে? চল্লিশ টাকা দিয়ে বই নিয়ে যান। বিনা পয়সাতেই আপনাকে দিতাম। ভাইয়া শুনলে রাগ করবে।
চল্লিশ টাকা আমার কাছে আছে—তুই বই নিয়ে আয়।
চা খাবেন?
না।
খান একটু, কি হবে খেলে? আপনি তো আসেনই না, বিয়ের পর প্রথম এলেন। বিয়ের পর প্রথম এলে মিষ্টি খাওয়াতে হয়। ঘরে কোনো মিষ্টি নেই। চিনি খাবেন? এক চামচ চিনি এনে দিতে পারি।
ফাজলামি ধরনের কথা। সুমি আমার সঙ্গে ফাজলামি ধরনের কথা কখনো বলে, আজ বলছে। চোখ-মুখ কঠিন করেই বলছে। তাকে ক্ষমা করে দিলাম কারণ অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এই মেয়েটি দুবছর আগে নপাতার একটি প্রেমপত্র লিখে রেজিস্ট্রি করে আমার নামে পাঠিয়েছিল। পুরো চিঠি পড়ার ধৈর্য ছিল না। দুতিন পাতা পড়েই আমার আক্কেল গুড়ুম। কি সর্বনাশ! সফিকের বাসায় তিন মাস যাওয়া বন্ধ রাখলাম। তিন মাস পর যখন গেলাম সুমির সঙ্গে খুব স্বাভাবিক আচরণ করলাম। সুমি চা দিতে এসে ক্ষীণ গলায় বলল, আপনি কি কোনো রেজিস্ট্রি চিঠি পেয়েছেন?
আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, আমাকে রেজিস্ট্রি চিঠি কে লিখবে? সুমি বিস্মিত হয়ে বলল, কোনো চিঠি পাননি?
আমি বললাম, না তো!
সুমির প্রণয় উপাখ্যানের এইখানেই সমাপ্তি।
চায়ের অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতেই সফিকের বাবা আইডিয়েল গার্লস স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক মোজাহার সাহেব এলেন। যতবার তাঁর সঙ্গে দেখা হয়, ততবারই আমার মনে হয় তাঁর বয়েস অনেকখানি বেড়েছে। আজ দেখি নিচের পটির একটা দাঁত পড়ে গেছে। তিনি ভারি চশমার আড়ালে খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, কে, রঞ্জু?
জ্বী।
সফিকের খোঁজে এসেছ?
জ্বী।
বাসায় এসে তাকে পাবে না। বাসার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নাই। সে গ্রামে গঞ্জে সাহিত্য করে বেড়াচ্ছে। কেন্দুয়া উপজেলায় তার একটা চাকরি হয়েছিল। উপজেলা হেলথ অফিসার। সে চাকরি নিল না। তার নাকি ঢাকা ছেড়ে যাওয়া সম্ভব না। তাতে বাংলা সাহিত্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
আমি কিছু বললাম না। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, হারামজাদা এখন দাড়ি কামানো বন্ধ করে দিয়েছে। অনেক দিন পরে দেখলাম—চিনতে পারিনি। এই অবস্থা! আবার শুনেছি এর মধ্যে নাকি একটা বই লিখে ছাপিয়ে ফেলেছে। আরে ব্যাটা তুই হচ্ছিস ডাক্তার, তুই করবি ডাক্তারি। তোর বই লেখালেখি কি? বই লেখার টাকা কোত্থেকে পেয়েছে কে জানে। তোমার কাছ থেকে নিয়েছে নাকি?
জ্বী-না।
আমার ধারণা ওর মার কোনো গয়না-টয়না নিয়ে বেচে ফেলেছে। ওর মা অবশ্য অস্বীকার করছে। ছেলে ওর চোখের মণি। সারাজীবন খালি ছেলে ছেলে করেছে। এখন বুঝবে ছেলের মজা।
সুমি চা এনে সামনে রাখল। মোজাহার চাচা ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। মনে হচ্ছে ইদানীং তিনি চোখেও কম দেখেন। যাবার সময় দরজায় ধাক্কা খেলেন।
সুমি বই দিয়ে গেল। আমি তাকে চল্লিশটা টাকা দিলাম। সুমি বলল, পনেরোটা বই আমার বিক্রি করার কথা। একটা মাত্র বিক্রি করলাম। আপনি কি আরেকটা কিনবেন?
আরেকটা দিয়ে আমি কি করব?
ভাবীর জন্যে নিয়ে যান। আপনি একটা পড়বেন, ভাবী পড়বেন আরেকটা।
আরেকদিন যখন আসব আরেকটা কিনে নিয়ে যাব। আজ টাকা নেই।
বাকিতে নিয়ে যান। পরে টাকা দেবেন।
আচ্ছা যা, নিয়ে আয়।
সুমি আরেকটা বই এনে দিল। আমাকে বিদায় দিতে গেট পর্যন্ত এল। আমি যখন বললাম, যাই সুমি, তখন সে নিচু গলায় বলল, আপনাকে একটা কথা বলি, রাগ করবেন না তো?
না। কি কথা? আপনার স্ত্রীর সাথে আপনার নাকি ছাড়াছাড়ি হয়ে যাচ্ছে?
কে বলল?
সুমি চুপ করে রইল। আমিও খানিকক্ষণ চুপ থেকে রাস্তায় পা বাড়ালাম। এই নিয়ে সুমির সঙ্গে কথাবার্তা বলার মানে হয় না।
বাসায় সঙ্গে সঙ্গে রওনা হলাম না। অকারণে অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে রাত এগারোটা বাজিয়ে ফেললাম। বাসায় ফিরে দেখি রূপা খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমুবার আয়োজন করে ফেলেছে। লাবণ্যকে নিয়ে এসেছে তার ঘরে। আমার জন্যে বিন্দুমাত্র উদ্বেগও লক্ষ করলাম না। এত দেরি কোথায় করলাম তা-ও জানতে চাইল না। আমি নিজ থেকে বললাম, সফিকের কাছে গিয়েছিলাম। ওর একটা বই বেরিয়েছে।
রূপা মশারি ফেলতে ফেলতে বলল, আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে বই ছাপাল আর আমাকে বলল না। আশ্চর্য তো!
তুমি টাকা দিয়েছ?
হুঁ। আচ্ছা লাবণ্যকে কি তার মার কাছে দিয়ে আসব, নাকি সে থাকবে। আমাদের সঙ্গে? খাট তো বড়ই আছে। থাকুক, কি বল?
থাকুক।
তুমি কি খেয়ে এসেছ?
না।
খাবে না?
না।
রূপা মশারির ভেতর ঢুকে পড়ল।
আমি সফিকের বই খুলে কয়েক পাতা পড়তে চেষ্টা করলাম। চৈত্র মাসের দুপুরের কথা দিয়ে বইটার শুরু। একটা ছেলেকে দেখা যাচ্ছে ঝাঝ রোদে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ টায়ার ফেটে যাওয়ায় সে মহাবিরক্ত। এই ছেলেটিই বোধহয় নায়ক। তবে ছেলেটার নাম লোকমান। লোকমান নামের কেউ কি নায়ক হবে? মনে হয় না। ঔপন্যাসিকরা বাস্তববাদী লেখা যতই লিখুন না কেন, নায়কনায়িকার নামের ব্যাপারে তাঁরা খুব সাবধান। নায়কের নাম তাঁরা রাখবেন—শুভ্র, নায়িকার নাম নীলাঞ্জনা।