হুঁ।
অসুবিধা হবে না তো? চিন্তা করে দেখ।
অসুবিধা হবে না।
তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে অসুবিধা হবে। তুমি বরং টেলিফোনে আগে কথা বলে নাও। ওরা খানিকটা মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে থাক।
টেলিফোন করার দরকার নেই।
রূপাকে নিয়ে বাসায় উপস্থিত হলাম রাত আটটার দিকে। রূপার বাবার বন্ধু এআইজি খালেকুর রহমান পুলিশের জীপে আমাদের নামিয়ে দিলেন।
রাত সাড়ে নটায় বাবার একটা মাইল্ড স্ট্রোক হল। আমার বাসর রাত কাটল সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করে।
আমি একা না, বাবুও সঙ্গে হাঁটছে। তাকে অসম্ভব চিন্তিত মনে হচ্ছে। ঘন ঘন সিগারেট ধরাচ্ছে। বড় ভাই হিসেবে সে আমাকে খানিকটা সমীহ করত, সামনে সিগারেট খেত না। আজ সে সব কিছুই বোধহয় মনে নেই। তবে আমার ধারণা, বাবাকে নিয়ে সে যতটা না চিন্তিত তার চেয়েও বেশি চিন্তিত যে আজ রাতটা নষ্ট হল। রাতটা কাজে লাগিয়ে অনেক কিছু সে নিশ্চয়ই পড়ে ফেলত নন নিউটোনিয়ান ফ্লো না কি যেন বলে ঐ সব।
দাদা।
হুঁ।
বিরাট ঝামেলা হয়ে গেল মনে হচ্ছে।
পড়াশোনার ক্ষতির কথা বলছিস?
সেই ঝামেলা তো আছেই। অসুখ-বিসুখ, হাসপাতাল-বাসা ছোটাছুটি। তার উপর তুমি আবার হুঁট করে বিয়ে করে ফেললে। ঐ নিয়ে বাড়িতেও নিশ্চয় টেনশন থাকবে।
তা কিছুটা থাকবে।
বাবু সিগারেট ধারতে ধরাতে বলল, তুমি এই ঝামেলাটা আমার পরীক্ষার পরে করলেও পারতে। মারাত্মক একটা ডিসটার্বেন্স হবে পড়াশোনায়। ভাবী নিশ্চয়ই ছাদে ঘুরঘুর করবে। মেয়েদের একটা টেনডেসিই থাকে ছাদে যাওয়া। কারণে-অকারণে ছাদে যাবে।
আমি নিষেধ করে দেব।
ইমমেডিয়েটলি কিছু বলার দরকার নেই। কয়েকটা দিন যাক। বাবার অবস্থা তোমার কি রকম মনে হচ্ছে?
এ যাত্রা টিকে যাবেন বলে মনে হয়।
বাবু শুকনো মুখে বলল, সব কটা ঝামেলা পরীক্ষার আগে শুরু হল। ধর ভালমন্দ কিছু যদি হয়, তাহলে এক মাস আর বই নিয়ে বসা যাবে না। আত্মীয়স্বজন… বিশ্রী অবস্থা হবে … আজকের পুরো রাতটা নষ্ট হল। কাল দিনটাও নষ্ট হবে।
কাল দিনটা নষ্ট হবে কেন?
রাত দুটা থেকে ভোর সাড়ে সাতটা–এই সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা না ঘুমালে দিনে পড়তে পারি না। মাথা জাম হয়ে থাকে। এখন বাজে তিনটা। এক ঘণ্টা তো চলেই গেল। বিরাট সমস্যা।
সমস্যা তো বটেই।
আমরা এখন কি করব? বাকি রাত হাসপাতালের বারান্দাতেই হাঁটাহাঁটি করে কাটাব?
হুঁ।
বাবু বিরক্ত মুখে বলল, আমরা হাঁটাহাঁটি করে তো বাবাকে কোন ভাবে হেল্প করতে পারছি না। লাভটা কি হচ্ছে?
তুই কি চলে যেতে চাচ্ছিস?
আমি চলে গিয়েই বা করব কি? বাসায় ফিরতে ফিরতে ধর রাত সাড়ে তিনটা বেজে যাবে … তারপর কি আর রেস্ট নেবার সময় থাকবে?
আমি বললাম, চল চা খেয়ে আসি। হাসপাতালের আশেপাশে চায়ের দোকান সারা রাত খোলা থাকে। বাবু বিরস মুখে বলল, চল।
চা খেতে খেতে বাবু বলল, মুনিয়া বলছিল, তুমি যে মেয়েটিকে বিয়ে করেছ সে নাকি দারুণ রূপবতী।
তুই এখনো দেখিস নি?
না। ভাবীকে নিয়ে তুমি যখন এলে তখন আমি ফ্রী পার্টিকেল প্রবলেম সলভ করছিলাম–নিচে নামতে ইচ্ছা করল না।
আমি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললাম, প্রতিটি পরীক্ষায় ফার্স্ট হবার উপকারিতাটা কি তুই আমাকে বল তো দেখি।
বাবু বিস্মিত মুখে বলল, তোমার কথা কিছুই বুঝলাম না। ঠিক কি জানতে চাচ্ছ বুঝিয়ে বল তো।
বুঝিয়ে বলার কিছু নেই। কথার কথা। চল খোঁজ নিয়ে দেখি। বাবার কি অবস্থা?
বাবার অবস্থা ভালই। বাবা সামলে উঠেছেন। ডাক্তার সাহেব বললেন, হার্টের কিছু না। হঠাৎ ব্লাড প্রেসার সুট করেছে, তাই এ অবস্থা।
বাবার কথা বলা সম্পূর্ণ নিষেধ, তবু তিনি ক্ষীণ গলায় আমাকে বললেন, এই কাজটা তুই কি করে করলি? শাদা চামড়া দেখে সব ভুলে গেলি? কি আছে শাদা চামড়ায়? বল তুই, কি আছে?
কিছু নেই।
সুন্দর চেহারা? কি হয় সুন্দর চেহারায় তুই বল।
কিছুই হয় না।
তাহলে কি মনে করে তুই এই কাজটা করলি? কি জানিস তুই এই মেয়ে সম্পর্কে?
বিশেষ কিছু জানি না।
মেয়ের বাবা–উনি করেন কি?
বলতে পারছি না। ব্যবসা-ট্যাবসা করেন বোধহয়।
উনার নাম কি?
নাম জানি না। কখনো জিজ্ঞেস করিনি। রূপাকে জিজ্ঞেস করে আপনাকে বলব।
বাবা চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
আমাদের বারান্দায় দুটি ইজিচেয়ার ছিল
আমাদের বারান্দায় দুটি ইজিচেয়ার ছিল। দুটি ইজিচেয়ারের একটি আমি আমার ঘরে নিয়ে এসেছি। বিয়ের পর আমার শোবার ঘরের পরিবর্তনের মধ্যে এই পরিবর্তনটা হয়েছে। ও আচ্ছা, আরেকটা পরিবর্তন হয়েছে ইজিচেয়ারের পাশে বড় একটা টেবিল ল্যাম্প। এই টেবিল ল্যাম্প রূপাদের বাড়ি থেকে এসেছে। রূপার বাবা দেশে ফিরেই তাঁর কন্যার ব্যবহারী শাড়ি, গয়না, কিছু ফার্নিচার একটা পিক আপ ভর্তি করে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তার সঙ্গে আধ পৃষ্ঠার একটা চিঠি। ব্যক্তিগত চিঠি—তাঁর কন্যাকে লেখা। আমার পড়ার কথা না, পড়া উচিতও না। যেহেতু চিঠি দু দিন ধরে আমার টেবিলে পড়ে আছে কাজেই আমি পড়েছি।
মা রূপা,
তোমার শাড়ি, গয়না, পাস বই, চেক বই পাঠালাম। ছোট স্যুটকেসটায় কসমেটিকস। তোমার ড্রেসিং টেবিলে যা পেয়েছি সবই দিয়ে দিয়েছি। কাজগুলি দ্রুত করতে হয়েছে, কারণ আমি আবার মাস তিনেকের জন্যে বাইরে যাচ্ছি। বাড়ি তালাবন্ধ থাকবে। চাবি তোমার রহমান চাচার কাছে থাকবে। প্রয়োজনে তার কাছ থেকে নিতে পার। তবে তাকে পাওয়া এক সমস্যা। তোমার ব্যবহারী জিনিসপত্র তোমাকে পাঠিয়ে দিয়েছি, তার মানে এই নয় যে হুঁট করে তুমি যে কাণ্ডটি করেছ তা ক্ষমা করা হয়েছে। তোমার জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠছিল, তার থেকে বাঁচার জন্য বিয়ে নামক ব্যপারটি ব্যবহার করেছ। বিয়ে সমস্যা থেকে বাঁচার কোনো ব্যবস্থা নয়। তোমার মাও সমস্যা এড়াবার জন্যে আমাকে বিয়ে করে অনেক বড় সমস্যা তৈরি করেছিলেন। আমি দুঃখিত হয়ে লক্ষ করছি, তোমার মা যেসব ভুল তার। জীবনে করেছিল, তুমিও একে একে তাই করতে যাচ্ছ। তোমার মা এক একটা ভুল করত, আর সেই ভূলকে যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করবার হাস্যকর চেষ্টা করত। তুমিও হয়তো তাই করবে। যে ছেলেটিকে তুমি ঝোঁকের মাথায় বিয়ে করলে সে কেমন ছেলে আমরা পক্ষে বলা সম্ভব নয়। তুমিই ভাল বলতে পারবে। তার সঙ্গে দুদিন। আমার দেখা হয়েছে। সামান্য কথা হয়েছে। আমার কাছে তাকে নির্বোধ বলে মনে হয়েছে। কে জানে, হয়তো নির্বোধ ছেলেই তোমার কাম্য।