- বইয়ের নামঃ পাখি আমার একলা পাখি
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অনুপম প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
আমি একটা খুন করব
আমি একটা খুন করব এই সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত নিয়ে ফেললাম। কদিন খুব অস্থির–অস্থির লাগছিল। সিদ্ধান্তটা নেয়ার পর অস্থির ভাব পুরোপুরি কেটে গেল। এক ধরনের আরামদায়ক আলস্যে মন ভরে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে টেবিল ঘড়ির দিকে তাকালাম। ভোর নটা পঁয়ত্রিশ মিনিটের লাল কাঁটা সাতের ঘরে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা সিদ্ধান্ত যে মুহূর্তে নেয়া হল, সেই মুহূর্তটা জানা থাকা দরকার। টেবিল ঘড়িতে সেকেণ্ডের কাটা থাকে না। কাজেই মুহূর্তটা আরো সূক্ষ্মভাবে জানা গেল না। মনটা একটু খুঁতখুঁত করছে।
আমার চোখ টেবিল ঘড়ির লাল কাঁটায় আটকে গেছে। আমি তাকিয়েই আছি। একসময় রূপা আমার কাঁধে ঝাকি দিয়ে বলল, এই কি দেখছ? রূপা আমার স্ত্রী। সে ধবধবে একটা শাদা চাদর গায়ে দিয়ে গুটিসুটি মেরে আমার পাশে শুয়ে আছে। শাদা চাদর গায়ে জড়ানো বলেই বোধহয় তাকে দেখাচ্ছে একটা বেড়ালের মতো। এমিতে অবশ্যি তার চরিত্রে বেড়াল ভাব অত্যন্ত প্রবল। সে সারাক্ষণই আরাম খোঁজে। নটা সাড়ে নটার আগে কোনোদিনই বিছানা ছেড়ে নামে না। আজ ছুটির দিন। কাজেই দশটা পর্যন্ত শুয়ে থাকবে বলে মনে হচ্ছে। রূপা আবার আমার কাঁধে ঝাঁকি দিয়ে বলল, কি দেখছ?
আমি হালকা গলায় বললাম, ঘড়ি দেখছি।
কটা বাজে?
নটা পঁয়ত্রিশ।
রূপা হাই তুলে বলল, ঘড়িটা বন্ধ হয়ে আছে। আমি রাতে ঘুমুতে যাবার সময়ও দেখেছি নটা পঁয়ত্রিশ। চাবি দেয়া হয়নি।
আমি আবার তাকালাম রূপার কথাই ঠিক। মিনিটের লাল কাঁটা এখনো সাতের ঘরে স্থির হয়ে আছে। আমি কখন এমন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিলাম তা জানা গেল না। মন আগে থেকেই খুঁতখুঁত করছিল। এখন বিরক্তিতে ভরে গেল। বিরক্ত হলেই আমার মুখে থুথু জমে। থুথু জমছে। মুখ ভর্তি হয়ে যাচ্ছে থুথুতে।
রূপা বলল, ড্রেসিং টেবিলের ওপর আমার হাতঘড়ি আছে। সময় দেখতে চাইলে ঐ ঘড়িতে দেখ। তবে ছুটির দিনে এত কিসের ঘড়ি দেখাদেখি? ঘুমাও তো।
এই বলেই সে চোখ বন্ধ করে ফেলল। সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়ল। রূপা অতিদ্রুত ঘুমুতে পারে। মাঝে মাঝে কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে যায়। তার সংঙ্গে পরিচিত নয় এমন কেউ হলে ভাবে হয়তো কথার খেই হারিয়ে থেমে গেছে। যারা তার সংঙ্গে পরিচিত তারা সবাই জানে সে ঘুমিয়ে পড়েছে। ট্রেনে কোথাও যাবার সময় তাকে জানালার কাছের একটা সীট দিতে হয়। সে খোলা জানালায় মাথা রেখে ট্রেন ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ে।
আমি বিছানা থেকে নামলাম। জমে থাকা থুথু জানালা দিয়ে ফেললাম। আমার ঘরটা ঠিক রাস্তার উপর। থুথু কারো মাথায় পড়ল কিনা কে জানে! পড়লে পড়ুক। ড্রেসিং টেবিলে রাখা রূপার হাতঘড়ি দেখলাম, সকাল সাতটা দশ। ছুটির দিনে এত ভোরে বিছানা ছাড়ার কোনো মানে হয়? রূপাকে জড়িয়ে ধরে আরো খানিকক্ষণ শুয়ে থাকব? তেমন কোনো প্রবল ইচ্ছাও বোধ করছি না। তাছাড়া রূপার গা ঠাণ্ডা। ধাতুর নামে নাম রাখার কারণেই বোধহয় তার বডি-টেম্পারেচার স্বাভাবিকের চেয়ে এক দু ডিগ্রী কম! রূপা চোখ বন্ধ করে ঘুম-ঘুম গলায় ডাকল, এ্যাই এ্যাই।
বল।
তুমি কি রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছ?
না।
একটু যাও না, প্লীজ। মুনিয়াকে বল আমাকে এককাপ কফি দিতে। তিন চামচ চিনি দিতে বলবে। দু চামচ উঁচু করে, এক চামচ সমান সমান। আর যদি ক্র্যাকার থাকে তাহলে একটা ক্রাকার। মাখন লাগিয়ে দিতে বলবে। মনে থাকবে?
থাকবে।
ফ্রীজ থেকে খুব ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানিও আনবে। আর শোন, পায়ের কাছের জানালাটা একটু বন্ধ করবে? ঘরে আলো আসছে।
রূপা এই দীর্ঘ কথাবার্তায় একবারও চোখ মেলল না। মনে হচ্ছে সে ঘুমের মধ্যে কথা বলছে। রূপার সংঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে গত আষাঢ় মাসে। এখন ফাল্গুন শুরু। প্রায় আটমাস হয়ে গেল। বিয়ের সময় তার মুখ ছিল লম্বাটে। শুধুমাত্র ঘুমিয়ে সেই মুখ এখন সে গোল করে ফেলেছে। গায়ের রঙও মনে হয় আগের চেয়ে ফর্সা হয়েছে। শাদা চাদরের আড়াল থেকে তার একটা পা বের হয়ে আছে। সে পায়ে শাড়ির আব্রু নেই। শখের মতো ধবধবে শাদা পা। মানুষের পা এত শাদা হয়, রূপাকে বিয়ে না করলে জানতাম না।
এ্যাই, এ্যাই।
বল।
পা-টা একটু ঢেকে দাও না।
রূপা আমার চেষ্টা ছাড়াই তার নগ্ন পা চাদরের ভেতর টেনে নিতে পারে। তা সে করবে না। ঐ যে বললাম বেড়াল স্বভাব। সবার কাছ থেকে আদর নেবে। যত্ন নেবে। আদর পাবার সামান্যতম সুযোগও সে ছাড়বে না।
আমি চাদর দিয়ে তার পা টাকলাম। পায়ের কাছের জানালা বন্ধ করলাম। এখন আমার কফি এবং ঠাণ্ডা পানির সন্ধানে যাওয়া উচিত। যেতে পারছি না। রূপার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। সব মেয়ে ঘুমুবার সময় চুল বেঁধে ঘুমায়। শুধু রূপার চুল থাকে ছাড়া। বালিশ ময় চুল ছড়ানো, মাঝখানে তার গোলাকার মুখ। সেই মুখ এতই সুন্দর যে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। অসম্ভব সুন্দর সহ্য করার ক্ষমতা মানুষের কম। কোনো সুন্দর জিনিসের দিকেই মানুষ বেশি সময় তাকিয়ে থাকতে পারে না। বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। আমাদের এ বাড়ির বারান্দা বেশ বড়। আজকালকার আর্কিটেক্টরা এই বারান্দা দেখলে চোখ কপালে তুলে বলবেন, ইশ কতোটা জায়গা নষ্ট করা হয়েছে। কোনো মানে হয়?