তরুণ : আমার বউ আছে।
ওস্তাদ : তার কি নাম?
তরুণ : ফুলি।
ওস্তাদ : বাহ্ বাহ্ বাহ্, কি সুন্দর নাম! ফুল থেকে ফুলি। শোন চান মিয়া–ফুলি না ডেকে এখন থেকে তুমি তাকে ডাকবে ফুলকুমারী।
তরুণ : জ্বি আচ্ছা।
ওস্তাদ : এখন তুমি এক কাজ কর, বস্তাটা ফেলে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াও। তারপর ফিরে যাও ফুলকুমারীর কাছে। [তরুণ গলা থেকে বস্তা নামিয়ে রাখবে। সঙ্গে সঙ্গে সে সোজা হয়ে দাঁড়াবে] যাও, এখন ফুলকুমারীর কাছে যাও। সে অপেক্ষা করছে তোমার জন্যে। অনেক দিন তো তার সঙ্গে তোমার দেখা হচ্ছে না, ঠিক না?
তরুণ : [হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়বে।]
[তরুণ সোজা হয়ে উল্টো দিকে চলে যাবে। আনন্দ ও উল্লাস-এর সংগীত বেজে উঠবে। হঠাৎ সমস্ত সংগীত থেমে যাবে। দেখা যাবে তরুণটি চোরের মত আবার ঢুকছে। স্বর্ণমুদ্রা ভর্তি ব্যাগ গলায় ঝুলিয়ে পিঠ বাঁকা করে সে অন্যরা যেদিকে গেছে সেদিকে রওনা হবে। একবারও তাকাবে না ওস্তাদজীর দিকে। ওস্তাদজী পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে সমস্ত ব্যাপারটি দেখবেন।]
[মঞ্চের অন্যপ্রান্ত থেকে ঢুকবেন রাজা। তাঁর মুখ হাসি হাসি]
রাজা : যদি দশটি স্বর্ণমুদ্রা থাকতো তাহলে সে হয়তো তোমার কথা শুনতো। বিশটি বা ত্রিশটি থাকলেও শুনতো। কিন্তু ওখানে আছে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা।
ওস্তাদ : এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা তুচ্ছ করতে পারে এমন মানুষও তো এ রাজ্যে আছে মহারাজা। আছে না?
রাজা : হয়তো আছে। কিন্তু তাদের জন্যে আছে দু’হাজার স্বর্ণমুদ্রার থলে। যারা দু’হাজারকে তুচ্ছ করবে তাদের জন্যে তিন হাজারের ব্যবস্থা আছে। [রাজা হাসতে থাকবেন।]
রাজ্য চালনা কঠিন কাজ ওস্তাদজী।
ওস্তাদ : হ্যাঁ খুবই কঠিন।
রাজা : আমি দূর থেকে সমস্ত ব্যাপারটা খুব আগ্রহ নিয়ে লক্ষ্য করছিলাম। এত আগ্রহ নিয়ে এর আগে কোনকিছু লক্ষ্য করিনি।
ওস্তাদ : মহারাজার আগ্রহের কারণ ঘটাতে পেরেছি। তার জন্যে বড় আনন্দবোধ করছি।
রাজা : আনন্দবোধ করাই উচিত। আমি তোমার উপর খুব খুশি হয়েছি।
ওস্তাদ : আপনার সুখের কারণ ঘটাতে পেরেছি। তাতেই আমার আনন্দ।
রাজা : ওস্তাদজী।
ওস্তাদ : বলুন জনাব।
রাজা : শুনলাম, তুমি না-কি আজকাল দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করেছ? ভয়াবহ সব দুঃস্বপ্ন!
ওস্তাদ : [চুপ করে আছে।]
রাজা : এবং তুমি তোমার দুঃস্বপ্নের কথা বলে বেড়াচ্ছ সবাইকে।
ওস্তাদ : স্বপ্ন খুব রহস্যময় বস্তু জনাব। এতে থাকে ভবিষ্যতের ইংগিত, কাজেই স্বপ্নের কথা বলতে হয়।
রাজা : ঠিক ঠিক। খুব ঠিক। বলাই উচিত। বলে তুমি ভালই করেছ। আমি তোমার উপর খুশি। খুব খুশি। নাও, তুমি এই মালাটা নাও। এটা তোমার জন্য।
ওস্তাদ : মহারাজার মালা গলায় পরার যোগ্যতা কি আমার আছে?
রাজা : ওস্তাদজী, মহারাজার মালা অযোগ্য লোকদের গলাতেই বেশি ঝুলে।
আমি কি ঠিক বলেছি?
ওস্তাদ : বলেছেন। ঠিক বলেছেন। আপনি মাঝে মাঝে এমন সব কথা বলেন যে আমি বিভ্রান্ত হয়ে যাই।
রাজা : [হাসি] বিভ্রান্ত হয়ে যাও। খুব ভাল বলেছ। একজন বুদ্ধিমান নৃপতির কাজই হচ্ছে আশেপাশের সবাইকে বিভ্রান্ত করে রাখা। দশটি মিথ্যা কথার সঙ্গে তিনটি সত্যি কথা মিশিয়ে দেয়া। দশটি ভুল সিদ্ধান্তের সঙ্গে দুটি সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া।
ওস্তাদ : আপনি বুদ্ধিমান।
রাজা : ধন্যবাদ।
ওস্তাদ : আমি কি যেতে পারি, মহারাজা?
রাজা : নিশ্চয়ই যেতে পারো। তবে শোন, একটি কথা তোমাকে বলা প্রয়োজন মনে করছি তোমার গান এখন আর আমাকে তৃপ্তি দিতে পারছে না। তোমার গলা নষ্ট হয়ে গেছে। এমন একটি সুন্দর কণ্ঠ তো নষ্ট হতে দেয়া ঠিক না। কি করে তোমার গলা ঠিক করা যায় বল তো?
[রাজা হাততালি দেবেন, মন্ত্রী এসে ঢুকবেন। রাজা আবার হাততালি দেবেন, দু’জন সভাসদ এসে ঢুকবে।] এর গলা নষ্ট হয়ে গেছে। কি করে এর গলা ঠিক করা যায় বল তো? আমি তার কণ্ঠের অপূর্ব সংগীত আবার শুনতে চাই।
[ সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করবে।] [আপন মনে]
অন্ধ গায়ক গায়িকারা খুব সুকণ্ঠ হয়। কি, হয় না?[ সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করবে।] ওকে নিয়ে যাও। নষ্ট করে দাও ওর চোখ। আমি আবার তার কণ্ঠে অপূর্ব সুরধ্বনি শুনতে চাই। আমি আবার আবেগে উদ্বেলিত হতে চাই। যাও ওকে নিয়ে যাও।
মন্ত্রী : [অবাক] মহারাজা!
রাজা : আহা, কেন প্রশ্ন করছো? ও তো করছে না। সে তো তার কণ্ঠে যৌবন ফিরে পেতে চায়। তাই না?
ওস্তাদ : [তাকিয়ে আছেন।]
রাজা : যাও, ওকে নিয়ে যাও।
[ওস্তাদ চলে যাবেন। তার পেছনে মন্ত্রী ও সভাসদরাও যাবে। আলো কমে আসবে। রাজা নিজ মনে পায়চারি করবেন ও হাসতে শুরু করবেন। অট্টহাসি শুনে রাণী ঢুকবেন।]
রাণী : [আতঙ্কিত হয়ে] কি হয়েছে?
রাজা : কিছু হয়নি। সব ঠিক আছে এবং দীর্ঘ দিন ধরে ঠিক থাকবে। এসো, তুমি আমার কাছে এসো!
[রাজা ও রাণীর প্রস্থান]
নৃপতি – সপ্তম দৃশ্য
সপ্তম দৃশ্য
[রাজার সিংহাসন। রাজা নেই। মন্ত্রী ও সভাসদরা আছেন।]
মন্ত্রী : মহিম গড়ের মহারাজা আজ প্রজাদের দর্শন দিতে পারছেন না। আসন্ন উৎসব নিয়ে তিনি একটি দীর্ঘ কাব্য রচনা করবেন বলে ঠিক করেছেন।
নকিব : মহারাজার জয় হোক।
সবাই : মহারাজার জয় হোক।
মন্ত্রী : বসন্ত উৎসব উপলক্ষে আমাদের প্রিয় নৃপতি এই রাজ্যের সমস্ত প্রজাদের জন্যে একটি বিশেষ উপহারের ব্যবস্থা করেছেন। তিনি সবাইকে সুখী দেখতে চান, আনন্দিত দেখতে চান।