১ম লোক : মহাসুখে আছি, মহানন্দে আছি।
[১ম লোক চলে যাবে। ২য় লোক ঢুকবে, মালা দেবে।]
রাজা : তুমি ভাল তো?
২য় লোক : জ্বি জনাব, ভাল। আমি সুখী-মহা-সুখী।
রাজা :কেন তুমি মহাসুখী?
২য় লোক : আপনাকে দেখতে পেয়েছি, তাই। রাজদর্শনে পুণ্য আছে। শাস্ত্রের কথা। পুণ্যতেই সুখ-মহাসুখ। প্রস্থান।
[৩য় ব্যক্তির প্রবেশ]।
৩য় লোক : হুজুর, এই মালাটি আমার কন্যা রাত জেগে নিজ হাতে গেঁথেছে আপনার জন্যে।
রাজা : রাত জেগে গেঁথেছে? আহা, আহা বড় কষ্ট হয়েছে তো।
৩য় লোক : আপনার জন্যে মালা গাঁথায় কোন কষ্ট নেই।
রাজা : মালা কে এত কষ্টের মালা কিন্তু কোন গন্ধ পাচ্ছি না কেন?
৩য় লোক : ফুলগুলি কাগজের, তাই গন্ধ নেই। রাজ্যে ফুলের বড় অভাব জনাব।
রাজা : হা হা। ঠিক ঠিক। আমার মনে ছিল না। গন্ধের কোন প্রয়োজন নেই। এর সৌন্দর্য তার গন্ধকে ছাপিয়ে উঠেছে। আমি তোমার কন্যার প্রতি প্রীতি হয়েছি। ওকে আমি পুরস্কৃত করতে চাই।
৩য় লোক: হুজরের অসীম দয়া। প্রজাদের প্রতি আপনার মমতার কোন সীমা নেই।
রাজা : চুপ, সব চুপ। আমি এর কন্যার জন্যে একটি কবিতা লিখে দেব। আমার ভাব এসে গেছে। কাগজ, কলম। আলো, আলো কমিয়ে দাও। গোধূলির পরিবেশ তৈরি কর। কলম, কলম।
নৃপতি – ষষ্ঠ দৃশ্য
ষষ্ঠ দৃশ্য
[রাণী একাকী হাঁটছেন। ওস্তাদের প্রবেশ]
রাণী : আপনি এসেছেন কেন? আপনাকে তো ডাকিনি! তাছাড়া আপনি এমন নিঃশব্দে কেন হাঁটেন? আমি চমকে উঠেছিলাম। এখানে আমার বুক কাঁপছে।
ওস্তাদ : মাঝে মাঝে চমকে ওঠা ভাল। এতে শরীর সুস্থ থাকে।
রাণী : আপনি কি চান আমার কাছে?
ওস্তাদ : শুনলাম কয়েক রাত ধরে আপনার ঘুম হচ্ছে না। আপনি দুঃস্বপ্ন দেখছেন।
রাণী : কোত্থেকে শুনলেন আমার ঘুম হচ্ছে না?
ওস্তাদ : রাজপ্রাসাদের সবাই আপনার দুঃস্বপ্নের কথা বলাবলি করছিল। অনেকেই মনে করছে যেহেতু মহারাণী দুস্বপ্ন দেখছেন কাজেই তাদেরও দেখা উচিত। কাজেই তারাও দেখছে। কয়েক রাত ধরে অনেকেই ঘুমুতে পারছে না, মহারাণী।
রাণী : আপনি দুঃস্বপ্ন দেখছেন?
ওস্তাদ : হ্যাঁ।
রাণী : কি দেখছেন?
ওস্তাদ : দেখলাম, মহানন্দে রাজ্যে বসন্ত উৎসব হচ্ছে, গান-বাজনা, আনন্দ-উল্লাস। রূপসী নর্তকীরা মহারাজাকে ঘিরে ঘিরে নাচছে। প্রাসাদের অলিন্দে দাঁড়িয়ে মহারাণী স্বয়ং প্রজাদের মধ্যে ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে দিচ্ছেন। একটি-দুটি ফুল নয়, লক্ষ লক্ষ ফুলের অযুত নিযুত পাপড়ি। কি অপূর্ব তার সৌরভ।
রাণী : এ-তো চমৎকার একটি স্বপ্ন। একে দুঃস্বপ্ন বলছেন কেন?
ওস্তাদ : দুঃস্বপ্ন বলছি কারণ ফুলের পাপড়ি আপনি যাদের দিচ্ছেন তারা ফুল চায় না।
রাণী : তারা কি চায়?
ওস্তাদ : ভাত চায়।
[রাণী তাকিয়ে থাকবেন। এবং দ্রুত চলে যাবেন। ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজতে থাকবে।] একজনের পেছনে একজন করে পিঠ-বাঁকার দল মঞ্চ অতিক্রম করবে। তারা পা ফেলছে তালে তালে।]
মজনু : জয়! মহারাজার জয়! [চলতে চলতে বলবে।]
বাকী সবাই : জয়! মহারাজায় জয়!
ওস্তাদ : তোমরা কোথায় যাচ্ছ?
মজুন : বসন্ত উৎসবের কথা দশজনেরে বলতে যাই, জনাব। মহারাজার দয়ার কথা সবারে বলতে যাই। মহারাজা দয়ার সাগর।
সবাই : দয়ার সাগর!
মজনু : আনন্দের সমুদ্র!
সবাই : আনন্দের সমুদ্র!
ওস্তাদ : বাঁকা হয়ে কি উৎসবের সংবাদ দিতে আছে? উৎসবের সংবাদ দিতে হয় সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে। বুক টান করে দাঁড়ান না সবাই।
মজনু : আমাদের অত সময় নাই। [চলে যাবে।]
বশির : আমাদের অত সময় নাই। [প্রস্থান।]
নেয়ামত : আমাদের অত সময় নাই। [চলে যাবে।]
সবাই : আমাদের অত সময় নাই। [চলে যাবে।]
[মঞ্চে শুধু বৃদ্ধ ও তরুণটি থাকবে। দু’জনেরই পিঠ বাঁকা।]
ওস্তাদ : বুক টান করে দাঁড়ান। মানুষের মত দাঁড়ান।
[দু’জনেই চেষ্টা করবে, পারবে না।]
বৃদ্ধ : এর ওজন বড় বেশি জনাব। সোজা হওন যায় না। অল্প কয়টা দিন বাঁচুম, বেঁকা হইয়া থাকলে অসুবিধা নাই। আচ্ছা ভাই, যাই। সেলাম।
[চলে যেতে ধরবে।]
[তরুণটি দাঁড়িয়ে আছে একা।]
ওস্তাদ : অল্প ক’টা দিন বাঁচবে, এই কটা দিন না হয় সোজা হয়েই বাঁচো।
বৃদ্ধ : লাভ তো কিছু নাই ওস্তাদজী।
ওস্তাদ : লাভ থাকবে না কেন? এই বয়সে এতো বড় একটা বোঝা!
তোমার কোমর তো ভেঙে যাচ্ছে।
বৃদ্ধ : কিন্তু জনাব, এই বোঝাটার একটা ইজ্জত আছে। এর কারণে পাঁচজনে আমারে সালাম দেয়। দুই-একটা জ্ঞানের কথা শুনতে চায়। রাজাসাবও আমারে পেয়ার করেন।
ওস্তাদ : তোমার লোকজন তো এক সময় তোমাকে ভালবাসতো তারা কি এখনো বাসে?
বৃদ্ধ : ছোড লোকের ভালবাসার কি কোন দাম আছে জনাব?
কোন দাম নেই। একটা ময়ূরপক্ষী এক হাজার কাকের সমান।
ওস্তাদ : বাহ, তুমি তো সত্যি সত্যি জ্ঞানের কথা বলতে শুরু করেছ!
বৃদ্ধ : আরো একটা কথা আছে, জনাব।
ওস্তাদ : বল, সেই কথাটাও শুনি।
বৃদ্ধ : আমি হইলাম মরণকালের বুড়া। আমার পিঠ বেঁকা থাকলেই কি, সোজা হইলেই কি? [তরুণকে ইঙ্গিত করে।]
যারার পিঠ সোজা থাকনের কথা তারাই বেঁকা ইয়া ঘুরতাছে। আচ্ছা ওস্তাদজী, যাই। সেলাম। [বৃদ্ধ চলে যাবে।]
ওস্তাদ : তোমার জোয়ান বয়স। তোমার বাঁকা হয়ে থাকা তো ঠিক না। নাম কি তোমার?
তরুণ : চান মিয়া।
ওস্তাদ : বাহ্, কি চমৎকার একটা নাম! এত সুন্দর নামের একটি ছেলে সারাজীবন বাঁকা হয়ে থাকবে? দেশের বাড়িতে কে আছে তোমার?