ওস্তাদঃ আমি কিছুই বলতে চাচ্ছি না। ওদের গান আপনার ভাল লাগলেই হল।
রাজাঃ আমার ভাল লেগেছে।
বৃদ্ধ : আমরা রাজা সাবের জইন্যে সকাল-বিকাল সইন্ধ্যা তিন বেলা গান গাইতে চাই।
বাকি সবাই : গাইতে চাই। তিন বেলা গান গাইতে চাই।
রাজা : গাইবে, দিনরাত তোমরা মন খুলে গাইবে। তোমাদের জন্যে আমি গান রচনা করব। সেই গান তোমরা ছড়িয়ে দেবে দেশে দেশান্তরে।
তিনজনেঃ দেশে দেশান্তর।
রাজা : পৃথিবীর মানুষেরা জানবে এই মহান নৃপতি শুধু প্রজাবৎসল নৃপতিই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন কবি এবং একজন মহান সুরকার।
তিনজনেঃ একজন মহান সুরকার।
রাজাঃ [বিরক্ত হয়ে] এরা বারবার আমার কথার পিঠে কথা বলছে কেন? ওদের ঘাড় ধরে বের করে দিন। [তিনজনেই তাড়াহুড়ো করে পালাতে গিয়ে একজন চিৎ হয়ে পড়ে যাবে।]
নৃপতি – চতুর্থ দৃশ্য
চতুর্থ দৃশ্য
[খোলা মাঠ। শো শো করে শীতের হাওয়া বইছে। তিনটি শিশু গায়ে চট জড়িয়ে বসে বসে শীতে কাঁপছে। বাচ্চাগুলির সঙ্গে বেশ কিছু গ্রামবাসী আছে। তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছ। এদের মধ্যে আছে ওসমান নামের অতি বৃদ্ধ এক ব্যক্তি। কাঁদের নামের এক তরুণ। লতিফা নাম্নী এক তরুণী। মঞ্চের এক কোণায় মাটির মালসায় আগুন। অতি বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা আগুন তাপাচ্ছে। কারো মুখে কোন কথা নেই। হঠাৎ দূরাগত ধ্বনি শোনা যাবে। আনন্দের বাজনা বাজছে ও তা ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। গ্রামবাসীরা উৎকীর্ণ হয়ে প্রতীক্ষা করবে। দেখা যাবে লাঠিতে ভর দিয়ে মজনু আসছে। সে একবারও না থেমে একই গতিতে মঞ্চ অতিক্রম করবে। কথাবার্তা যা হবে চলার মধ্যেই হবে।]
বৃদ্ধ : বড় কষ্ট! বড় কষ্ট! শীত জবর পড়ছে। বুড়া-মরণের শীত পড়ছে।
এই শীতে সব বুড়া শেষ হবে রে। বুড়ার দল সব শেষ।
তরুণ : শেষ হইলেই ভাল। বুড়া দিয়া কি হয়? কিছু না।
তরুণী : এইটা কেমন কথা? ও বুড়ো চাচা, আপনে আগুনের কাছে গিয়া বসেন। হাত দুইটা মেলেন আগুনের উপরে।
বৃদ্ধ : দুই দিকে আগুন জ্বলে রে বেটি। পেটের মইধ্যেও আগুন। খিদার আগুন। সেই আগুনের কষ্ট আরো বেশি।
তরুণ : এক কাজ করেন চাচা মিয়া, হা কইরা এট্টু আগুন খাইয়া ফেলেন। আগুনে আগুনে শান্তি। পেট ঠাণ্ডা হইব। হা হা-হা।
তরুণী : চুপ কর। লজ্জা নাই? কেমন কথা কও?
তরুণ : মজাক করি রে মজাক করি। রাইতটা তো কাটান দেওন লাগব। হাসি-মজাক কইরা রাইত পার করি। ও চাচা মিয়া, গোসা হইছেন?
বৃদ্ধ : [কথা বলবে না]
তরুণ : গোসা কইরেন না চাচা মিয়া। শীতের মইধ্যে মাথার ঠিক থাকে না। একটা কিচ্ছা কন দেখি।
বৃদ্ধ: [চুপ করে থাকে]
অন্য একজন : কন গো, একটা কিচ্ছা কন। কিচ্ছা হুনতে হুনতে রাইতটা পার করি।
বৃদ্ধ : [চুপ]।
সবাই : কনগো কন, একটা কিচ্ছা কন।
বৃদ্ধ : এক দেশে আছিল এক রাজা।
তরুণ : রাজার গল্প বাদ দেন। একটা গরীব মাইনষের গল্প কন দেহি।
বৃদ্ধ : গরীব মাইনষের কোন গস্প হয় না। খামাখা কথা কইও না। গল্পটা হুন মন দিয়া। শুনতে মনে না চায় দূরে গিয়ে বইসা থাক। এক দেশে আছিল এক রাজা। তরুণ উঠে দূরে চলে যায়। সেই রাজার বড় শান শওকত। বেশুমার খানা-খাদ্য।
অন্য একজন : কি খানা-খাদ্য এট্টু কন শুনি।
বৃদ্ধ : কি কমু কও? রাজবাড়ির খানা-খাইদ্যের হিসাব-নিকাশ নাই। সেই রাজার হাতিশালে হাতী, ঘোড়াশালে ঘোড়া। লোক-লস্কর, পাইক বরকন্দাজ। কিন্তু রাজার মনে সুখ নাই।
তরুণী : তবু সুখ নাই? কন কি? ক্যান? সুখ নাই ক্যান?
বৃদ্ধ : রাজা হইল আটকুড়া, তার পুত্রসন্তান নাই।
তরুণী : আহা রে!
বৃদ্ধ : পুত্রসন্তানের কারণে রাজা শুধু বিয়া করে। যেখানে যত সুন্দর কন্যা পায় বিয়া করে। কিন্তু পুত্রসন্তান হয় না। [তরুণ শব্দ করে হেসে উঠবে।]
হাস ক্যান?
তরুণ : আটকুড়া রাজা হইতে মনে চায়।
[সবাই হেসে উঠবে। এবং হাসি থেমে যাবে।]
তরুণী : এর পরে কি হইল কন? পুত্রসন্তান হইল?
বৃদ্ধ : কিচ্ছা আইজ থাউক। মন ভাল লাগছে না। বড় কষ্ট রে, বড় কষ্ট! শীতের কষ্ট। ক্ষিদার কষ্ট।
তরুণী : একটা ক্ষিদার কিচ্ছা কন্ তো চাচা মিয়া? জানা আছে?
অন্য একজন : চুপ, চুপ, চুপ। পায়ের শব্দ পাওয়া যায়। রাজার লোক আসতাছে। [সবাই চুপ]
তরুণ। : পায়ের শব্দ না গো, বাতাসের শব্দ। ঠাণ্ডা বাতাস। বড় ঠাণ্ডা বাতাস।
বৃদ্ধ : সমস্ত দিন গেল। সইন্ধ্যা গেল। চাইরদিক অন্ধকার। ঠাণ্ডা শীতের বাতাস। রাজার খবর নিয়া তো এখনো কেউ আইল না।
সকলেঃ আসে না। কেউ আসে না।
তরুণী : পায়ের শব্দ শোনা যায়। ভাল কইরা চাইয়া দেখেন। কাউরে দেখা যায়?
সকলে : না। কেউ না।
বৃদ্ধ : শীতের বাতাস বয়, শরীর দুর্বল হইছে, বড় কষ্ট হয়।
তরুণী : পায়ের শব্দ শোনা যায় চারদিকে চউখ ফেলেন
রাজা সাবের লোকজন কাউরে দেখা যায়?
সকলে : না, কেউ নাই।
বৃদ্ধ : শীতের বাতাস বয়
শরীর দুর্বল হইছে, বড় কষ্ট হয়।
অন্য একজন : চুপ করেন, চুপ করেন,
কোন কথা নাই।
কে যেন আসতে ধরছে লাঠির শব্দ নাই।
ওসমান : তুমি কেডা?
মজনু : আমি মজনু।
ওসমান : বাদ্য-বাজনা শোনা যায়। আসে কেডা?
মজনু : রাজার পয়গাম আসতেছে। বড় সুসংবাদ।
[ দ্বিতীয় প্রজা নিয়ামত পিঠ বাঁকা করে ঢুকবে। সেও প্রথমজনের মত মঞ্চ অতিক্রম করবে।]
তরুণ : আপনে কেডা?
বশির : আমার নাম বশির।