রাণী : আপনি চলে যান আমার সামনে থেকে। [ওস্তাদ কুর্নিশ করে চলে যেতেই রাণী হাততালি দেবেন। সহচরী দু’জন এসে ঢুকবে।] মহারাজার কোন খবর পাওয়া গেছে?
সহচরী : [না সূচক মাথা নাড়বে।]
রাণী : মাঝরাতে ঘুম ভাঙ্গলে তোমরা কি কোন পায়ের আওয়াজ পাও?
সহচরী : [না সূচক মাথা নাড়বে।]
[ঠিক তখন নকিবের গলার আওয়াজ।]
নকিব : মহিম গড়ের মহামান্য রাজা, অজাতশত্রু, ভীমবাহু, মহাবল বীরশ্রেষ্ঠ মহারাজা রাজপ্রাসাদে এসে পৌঁছেছেন।
[সহচরী দু’জন বের হয়ে যাবে, মহারাজার প্রবেশ]।
রাণী : আপনার ফিরতে দেরি দেখে বড় ভয় পেয়েছিলাম।
রাজা : পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম। এক বিশাল মাঠের মাঝখানে বসে বসে আকাশের তারা দেখছিলাম।
রাণী : প্রজাদের অবস্থা কেমন দেখলেন?
রাজা : মাঠের মধ্যে সন্ধ্যা নামল। ক্রমে ক্রমে চারদিকে অন্ধকার হচ্ছে। চারদিকে পাখি ডাকছে। কি চমৎকার দৃশ্য! মনে বড় আনন্দ হলো রাণী।
রাণী : প্রজাদের তাহলে দেখতে যাননি?
রাজা। : এত চমৎকার বাতাস বইছিল–এত আনন্দ চারদিকে তোমাকে একদিন নিয়ে যাবে সেখানে। দু’জনে পাশাপাশি বসে সন্ধ্যা হওয়া দেখব। সেই মাঠে আমরা ছোট-খাটো উৎসবের মত করতে পারি।
রাণী : কবে? কবে নিয়ে যাবেন? আমার এক্ষুণি যেতে ইচ্ছা করছে। আমরা কি কাল যেতে পারি?
রাজা : নিশ্চয়ই পারি।
রাণী : প্রজাদের কথা যেসব শুনছি সেসব তাহলে ঠিক নয়। ওরা সুখেই আছে, তাই না মহারাজা?
রাজা : দুঃখ নিয়ে মাতামাতি করা আমার পছন্দ নয়। দুঃখ থাকবেই। সেই দুঃখ থেকে ওদের মন ফিরিয়ে নেব। ওদের জন্যে একটা উৎসব করব।
রাণী : উৎসব?
রাজা : চমৎকার একটি উৎসব। আনন্দ-উল্লাস-গান। আকাশ ভরা থাকবে জোৎস্না। পুরনারীরা হাত ধরাধরি করে নাচবে।
রাণী : চমৎকার। কিন্তু …। শুনছি হাজার হাজার মানুষ রাজপ্রাসাদের দিকে আসছে।
রাজা : কোথায় শুনেছ?
রাণী : সত্যি নয় তাহলে?
রাজা : না, সত্যি নয়। তাছাড়া সত্যি হলে কিছু যায় আসে না। ওদের আসতে দাও। ওরা আসুক, যোগ দিক আমাদের উৎসবে। এ উৎসব শুধু তোমার আমার উৎসব নয়। এ উৎসব আমাদের সবার। আমরা সবাই মিলে নাচবো, সবাই মিলে গাইবো। ফুলে ফুলে রাজ্য ঢেকে দেব। রাণী… ।
রাণী : বলুন!
রাজা : যাও, ফুল-সাজে সেজে আস। আজ আমার মনে বড় আনন্দ। বড় সুখের সময় আজ। তুমি অপরূপ সাজে সেজে দাঁড়াও আমার সামনে। সভাসদদেরও আসতে বল। আজ আমি সবাইকে পুরস্কৃত করবো।
রাণী : আমি আসছি। আমি এক্ষুনি আসছি। [প্রস্থান]
[মন্ত্রী প্রবেশ করবেন]
মন্ত্রী : মহারাজা আমাকে স্মরণ করেছেন?
রাজা : আমি আজ সবাইকে স্মরণ করেছি। আজ আমার মনে গভীর আনন্দ। আজ আমি সবাইকে পুরস্কৃত করব। কিন্তু তোমাকে আজ এত মলিন দেখাচ্ছে কেন?
মন্ত্রী : আমার গায়ের রঙটাই ময়লা মহারাজা।
রাজা : তোমার ঘোর কৃষ্ণবর্ণেও আনন্দের জ্যোতি ছিল। আজ তা দেখছি না।
মন্ত্রী। : হেতমপুর থেকে হাজার হাজার প্রজা এসেছে, তারা আপনার দর্শনপ্রার্থী। আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়।
রাজা : এখন তো আমার কথা বলার সময় নেই মন্ত্রী।
মন্ত্রী : অপেক্ষা করতে বলব?
রাজা : হ্যাঁ, অপেক্ষা করুক। ভূষণ্ডির মাঠে বসে অপেক্ষা করুক। সময় হলেই আমি ওদের দর্শন দেব। কিংবা আমার বার্তা নিয়ে লোক যাবে। সে বার্তা হবে আনন্দের বার্তা। সুখের বার্তা।
মন্ত্রী : এই শীতের রাতে মাঠে বসে থাকবে?
রাজা : (চমকে) এই কি শীতকাল?
মন্ত্রী : [হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়বেন।]
রাজা : শীত হলেও ভূষণ্ডির মাঠের দৃশ্য বড় চমৎকার। আকাশে চাঁদ আছে। ফুলে সৌরভ আছে। পাখির গান আছে। চারদিকে আনন্দ চিকমিক করছে। ওদের সময় ভালই কাটবে। [নেপথ্য থেকে শোনা যাবে কথা বলতে চাই। আমরা কথা বলতে চাই। মহারাজা কান পেতে শুনবেন ও বিরক্ত হয়ে মঞ্চ ত্যাগ করবেন। মন্ত্রীও যাবেন। গ্রামবাসীর দল কথা বলতে চাই, আমরা কথা বলতে চাই–বলতে বলতে মঞ্চে প্রবেশ করবে। রাজার নকিব এসে দাঁড়াবে। গর্বিত ভঙ্গিতে।
তরুণী : টুপিওয়ালা ভাই– রাজা সাবের সাথে আমরা কথা বলতে চাই।
নকিব : রাজা সাব ব্যস্ত মানুষ এত সময় নাই।
বৃদ্ধ ঃ টুপিওয়ালা ভাই রাজা সাবের সাথে দুইটা কথা বলতে চাই। সময় আমরার অনেক আছে সময়ের অভাব নাই। [দলের সবার দিকে তাকিয়ে] ওরে তোরা বস। [সবাই বসে পড়বে] [নকিব রেগে গিয়ে একজনকে টেনে তুলে এক চড় বসিয়ে দেবে।]
নকিব : মনে নাই ডর ভয় পা ছড়াইয়া ক্যামনে বয় [সবাই উঠে দাঁড়াবে।]
এই কথাটা মনে রাখন চাই। রাজবাড়ির সামনে কারুর বসার হুকুম নাই। হেতমপুরের বোকার দল, আইন জানা নাই?
তরুণী : টুপিওয়ালা ভাই, কোন জায়গাতে বইসা থাকম্ এইটা জানতে চাই।
নকিব : ভূষণ্ডির মাঠে যাও। জায়গাটা ভাল। ফুলের গন্ধ আছে। পাখির গান আছে। চান্দের আলো ভি আছে। যখন সময় হবে, খবর নিয়ে সেইখানেতে মোদের লোক যাবে।
তরুণী : টুপিওয়ালা ভাই।
খবরটা একটু যেন তাড়াতাড়ি পাই।
নকিব : রাজা সাবের অত তাড়া নাই।
সকলেঃ কথা বলতে চাই।
[বলতে বলতে ভূষণ্ডির মাঠের দিকে রওনা হবে।]
নৃপতি – তৃতীয় দৃশ্য
তৃতীয় দৃশ্য
[রাজা সিংহাসেন বসে আছেন। চোখ আধ-বোজা। সিংহাসনের পাশে একজন ওস্তাদ দরবারী কানাড়া গাইছেন। দরবারে রাজার মেজাজ আনার জন্যে। ওস্তাদের গলা অদ্ভুত সুন্দর, তিনি গাইছেনও চমৎকার। সরগমের মাঝখানে রাজা হাততালি দিয়ে গান থামিয়ে দেবেন।]