রাজা : কষ্ট হচ্ছে?
চোর : না হুজুর। আরাম লাগতাছে। হুজুরের শইলডা মাখনের মত নরম। বড় আরাম হুজুর।
রাজা : আস্তে আস্তে যাবে। কোন তাড়া নেই। ঝাঁকনি দেবে না। আমার ঝাঁকনি সহ্য হয় না।
চোর :জ্বে আইচ্ছা। খুব আস্তে যামু।
রাজা : তোমার যেন কি নাম বললে?
চোর : মজনু।
রাজা : মজনু, বেশ সুন্দর বাতাস দিচ্ছে। এটা কি বসন্তকাল?
চোর : এইডা হুজুর শীতকাল।
রাজা : না, না, না। শীতকাল হতেই পারে না। আমি ফুলের ঘ্রাণ পাচ্ছি। তুমি পাচ্ছ না?
চোর : জ্বে না হুজুর, আমার সর্দি। [নাক ঝাড়বে]
রাজা : তোমার নামটা যেন কি?
চোর : মজনু।
রাজা : মজনু, তুমি গান জান?
চোর : হাঁপাতে হাঁপাতে জ্বি না হুজুর।
রাজা : আমার কবিতা লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে মজনু।
মজনু : হুজুর, এট্টু নামেন পিঠ থাইক্যা।
রাজা : কষ্ট হচ্ছে?
মজনু : কোন কষ্ট না, তয় হুজুর দমটা বন্ধ হইয়া আসতাছে। এট্টু নামেন। [রাজা নামবেন। মজনু বড় বড় করে শ্বাস নিতে থাকবে। জামা খুলে সে নিজেকে প্রবল বেগে বাতাস করতে থাকবে। মঞ্চে একজনের পেছনে একজন দল বেঁধে প্রবেশ করবে। তাদের দলপতি এক বৃদ্ধ]
রাজা: ওরা কারা? মজনু, জিজ্ঞেস কর ওরা কারা?
মজনু : [উচ্চস্বরে] তোমরা কে?
বৃদ্ধ : আমরা হেতমপুরের প্রজা।
রাজা : তোমার কোথায় যাও?
মজনু: [উচ্চস্বরে] তোমার কোথায় যাও?
বৃদ্ধ : আমরার পেটে ভাত নাই,
এই কথাটাই– রাজা সাবরে নিজের মুখে বলতে চাই।
তরুণী : রাজা সাবরে বলতে চাই। আমরার পেটে ভাত নাই শীত পড়ছে আকাশ-পাতাল শীতে কষ্ট পাই।
রাজা : হেতমপুর কতদূর?
সকলে : হেতমপুর-অনেকদূর!
রাজা : এই সামান্য কথা বলবার জন্যে এতদূর থেকে এসেছ?
সকলে : ভাতের কষ্ট বড় কষ্ট এর উপরে কষ্ট নাই।
বৃদ্ধ : এই কথাটাই রাজা সাবরে নিজের মুখে বলতে চাই।
মজনু : অত কথা শুনবার সময় রাজা সাবের নাই।
সকলে : কথা বলতে চাই। আমরা কথা বলতে চাই।
তরুণী : রাজা সাবরে বলতে চাই। আমরার পেটে ভাত নাই ভাতের কষ্ট বড় কষ্ট এর উপরে কষ্ট নাই। এই কথাটা রাজা সাবরে নিজের মুখে বলতে চাই।
সকলে : কথা বলতে চাই। আমরা কথা বলতে চাই।
[এই সুরে গান গাইতে গাইতে তারা এগিয়ে যাবে। মজনু পিঠ বাঁকা করে দাঁড়াবে। রাজা চিন্তিত মুখে তার পিঠে চড়বেন। তাঁরা রওনা হবেন।]
[মঞ্চের আলো কমে আসবে। রাজার মুখ চিন্তাক্লিষ্ট। দূর থেকে গম্ভীর গলায় একক কণ্ঠে শোনা যাবে–]
“এক দেশে এক রাজা ছিল
রাজার অনেক সৈন্য ছিল।
ঘোড়াশালে ঘোড়া ছিল। …………….।”
নৃপতি – দ্বিতীয় দৃশ্য
দ্বিতীয় দৃশ্য
[অপরূপ বেশভূষায় সজ্জিত হয়ে রাণী ঢুকছেন। রাণীর পেছনে ফুলের সাজী হাতে দুইজন সহচরী। রাণী ঘুরছেন অস্থির হয়ে। রাণীর পিছনে পিছনে সহচরীরা ঘুরছে।]
রাণী : মহারাজা প্রাসাদে এখানে এসে পৌঁছেন নি?
সহচরী : [না সূচক মাথা নাড়বে।]
রাণী : এত সময় তো লাগার কথা নয়? আমার ভাল লাগছে না।
১ম সহচরী : সুরশিল্পী আসমত আলী খাঁন সাহেবকে আসতে বলব? গান শুনিয়ে তিনি আপনাকে তুষ্ট করবেন।
রাণী : প্রথম প্রহর পার হয়েছে, আমার খুব অস্থির লাগছে। কিছুতেই মন বসছে না। প্রজাদের দেখতে বেরিয়েছেন। ওদের দেখার কি আছে?
১ম সহচরী : ওস্তাদজীকে আসতে বলি?
রাণী : প্রধানমন্ত্রী বলছিলেন দেশের অবস্থা ভাল নয়। প্রজারা অসন্তুষ্ট। চারিদিকে অভাব। এই সব বলে বলে তারা মহারাজাকে বিরক্ত করেছে। নয়ত তিনি বের হতেন না। আমার ভাল লাগছে না।
১ম সহচরী : ওস্তাদজীকে বলি আপনার প্রিয় গান গেয়ে শুনাবার জন্যে। এতে মহারাণীর মন প্রফুল্ল হবে। বলব?
রাণী : না, না। আমার কিছুতেই মন বসছে না। তোমরা আমাকে বিরক্ত করবে না।
২য় সহচরী : চলে যাব?
রাণী : যাও, চলে যাও।
১ম সহচরী : আপনি একা থাকবেন?
রাণী : চলে যেতে বলছি, চলে যাও, কেন কথা বাড়াচ্ছ? আমি একা একা খানিকক্ষণ বাগানে হাঁটব। মহারাজা এসে পৌঁছান মাত্র আমাকে খবর দেবে।
[সহচরী দু’জন চলে যাওয়ার পর ওস্তাদজী ঢুকবেন।]
ওস্তাদজী : মহারাণী, আমাকে স্মরণ করেছেন?
রাণী : আমি কাউকে স্মরণ করিনি।
ওস্তাদ : ওরা বলছিল আপনার মন বিক্ষিপ্ত। বিক্ষিপ্ত মনকে শান্ত করবার জন্যে সঙ্গীতের মত আর কিছুই নেই। আপনি চাইলে মালকোষ রাগে…।
রাণী : আমি কিছুই চাই না। আচ্ছা, আপনি বলুন তো প্রজাদের দেখতে যাবার এই খেয়াল মহারাজার কেন হল? কি মানে থাকতে পারে এর?
ওস্তাদ : রাজাদের কিছু অদ্ভুত খেয়াল থাকতে হয়। তা না থাকলে সবাই ওদের সাধারণ মনে করবে। নৃপতিরা অসাধারণ থাকতে পছন্দ করেন।
রাণী : তারে মানে?
ওস্তাদ : দেশ জুড়ে অভাব! ঘরে ঘরে হাহাকার। এর মধ্যে দেখার কিছুই নেই। মন প্রফুল্ল করার মত কোন দৃশ্য নয়। তবে, রাজারা মাঝে মাঝে মানুষের কষ্ট দেখতে ভালবাসেন। মানুষের দুঃখ-কষ্ট দেখার মধ্যেও আনন্দ আছে।
রাণী : এসব আপনি কি বলছেন?
ওস্তাদ : প্রজারা যখন রাজপ্রাসাদের চারিদিকে ঘিরে দাঁড়াবে, তখন আপনি ছাদে দাঁড়িয়ে তাকাবেন ওদের দিকে। আপনার ভালই লাগবে। দুঃখী মানুষদের দেখতে বড় ভাল লাগে। অন্যের দুঃখকে খুব কাছ থেকে না দেখতে পেলে নিজের সুখ ঠিক বোঝা যায় না মহারাণী।
রাণী : প্রজারা রাজপ্রাসাদ ঘিরে দাঁড়াবে? [ওস্তাদ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়বেন] কবে?
ওস্তাদ : তা তো বলতে পারব না। গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে ওদের পায়ের শব্দ শুনি। ওরা আসতে শুরু করেছে মহারাণী।