- বইয়ের নামঃ নৃপতি
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ জ্ঞানকোষ প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
নৃপতি – প্রথম দৃশ্য
প্রথম দৃশ্য
[অন্ধকার মঞ্চ। বেদীর মত একটি স্থান। কেউ একজন গর্বিত ভঙ্গিতে বসে আছে সেখানে। মঞ্চ ক্রমে ক্রমে আলোকিত হচ্ছে। ভারী ও গম্ভীর গলায় নেপথ্য থেকে কেউ একজন কথা বলবে।]
নেপথ্য কণ্ঠ: মহিম গড়ের মহামান্য রাজা প্রজাদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখবার জন্যে পথে নেমেছিলেন। সন্ধ্যার আগেই তার রাজপ্রাসাদে ফেরার কথা তিনি ফিরলেন না। পথ হারিয়ে ভূষণ্ডি মাঠে বসে রইলেন। রাত বাড়তে লাগলো। আমাদের আজকের গল্প মহিম গড়ের নৃপতির গল্প। গল্প শুরু করছি এইভাবে– এক দেশে এক রাজা ছিল।
[কয়েকজন ছেলে ও দুটি মেয়ে সমবেত কণ্ঠে গাইতে থাকবে। সম্মিলিত কণ্ঠের বিলম্বিত সুরের গান ক্রমে উচ্চগ্রামে উঠবে। দেখা যাবে মঞ্চ আলোকিত হচ্ছে।]
একদেশে এক রাজা ছিল।
হাতীশালে হাতী ছিল।
ঘোড়াশালে ঘোড়া ছিল।
টাকশালেতে টাকা ছিল।
একদেশে এক রাজা ছিল।
একদেশে এক রাজা ছিল।
[মঞ্চ আলোকিত। উপবিষ্ট রাজাকে দেখা যাচ্ছে বিমর্ষ ভঙ্গিতে বসে আছেন। মঞ্চের অন্য প্রান্ত থেকে একজন বেরিয়ে এসে বেদীতে উপবিষ্ট রাজাকে অবাক হয়ে দেখবে।]
[প্রায় অন্ধকার মঞ্চে প্রবেশ করছে চোর। তার গায়ে কাঁথা, এক হাতে একটি পুটলি। অন্য হাতে বিড়ি। হাতে কিছু থাকবে না কিন্তু বিড়ি টেনে টেনে আসছে এমন একটি ভঙ্গি করবে। হঠাৎ সে রাজাকে দেখে থমকে দাঁড়াবে। দু’পা পিছিয়ে আসবে।]
রাজা : তোমার নাম, তোমার পরিচয়?
প্রজা : হুজুর আমারে জিগাইতেছেন? আমার নাম হইল গিয়া….
রাজা : তুমি কি আমাকে চিনতে পারছ?
প্রজা : আপনেরে চিনুম না! কন কি আপনে? হে-হে-হে-।
রাজা :তোমার স্পর্ধা দেখে অবাক হচ্ছি। আমাকে চিনতে পেরেও কুর্নিশ করনি! আবার দাঁত বের করে হাসছ। রাজার সামনে হাসতে হলে তার অনুমতি লাগে তাও জান না?
প্রজা : আপনেরে চিনতে পারি নাই। আল্লাহর কসম হুজুর এট্টুও চিনি নাই।
বড় আন্ধাইর।
রাজা : চিনতে পারনি।
প্রজা : জ্বে না। আন্ধাইরে রাজার চেহারা যেমুন, চোরের চেহারাও তেমুন।
রাজা : তুমি কি কর?
প্রজা : রাজা সাব, আমি একজন চোর।
রাজা : [স্তম্ভিত] চোর?
প্রজা : জে হুজুর। আমার বাপও চোর ছিল আর হুজুর আমার দাদা…
রাজা : যাও যাও। আমার সামনে থেকে চলে যাও। একজন চোর কথা বলছে আমার সঙ্গে! [চোর পায়ে পায়ে সরে যাচ্ছে। রাজা হঠাৎ মত বদলাবেন] এই চোর।
চোর : রাজা সাব ডাকলেন?
রাজা : আমি ভেবে দেখলাম চোর হলেও তুমি আমার প্রজা। এবং প্রজা হচ্ছে সন্তানতুল্য। কাজেই তুমি আমার সন্তান। ঠিক বলেছি কিনা বল?
চোর : এক্কবারে খাঁটি কথা কইছেন। হুজুর আপনে আমার পিতা।
রাজা : তুমি আমাকে মহিম গড়ের রাজপ্রাসাদে নিয়ে যেতে পারবে?
চোর : তা পারুম কিন্তু হুজুর আপনি এই মাঠের মইধ্যে ক্যামনে আইলেন?
আপনের সৈন্য সামন্ত কই? মুকুট কই? হাতী ঘোড়া কই? মন্ত্রী সাবরা কই?
রাজা : তোমার সঙ্গে খোশ-গল্প করার আমার কোন ইচ্ছা নেই।
চোর : হুজুরের কাছে অস্ত্রপাতি কিছু আছে? তলোয়ার, ছুরি, চাকু?
রাজা : প্রজারা আমার সন্তানের মত। ওদের কাছে আমি নিরস্ত্র অবস্থায় যেতে পছন্দ করি। [চোর তার ঝুলি হাতড়ে ভয়াল-দর্শন একটা ছোরা বের করবে।] আমাকে ঠিকমত রাজপ্রাসাদে পৌঁছে দিলে প্রচুর ইনাম পাবে। তোমার হাতে ওটা কি? [চোর ছোরার ধার পরীক্ষা করবে] হাতের এই জিনিসটা ফেলে দাও।
চোর : [হেসে উঠবে]
রাজা : হাসছ কেন?
চোর : জিনিসটার মইধ্যে জবর ধার। আর এইটা বার করছি হুজুর আপনার জইন্যে। সেরেফ আপনার জইন্যে।
রাজা : [রাজা স্তম্ভিত ও ভীত।] আমার জন্যে?
চোর : জ্বে হুজুর। যদি কেউ আপনেরে আক্রমণ করে। দুষ্টু লোকের তো হুজুর দেশে অভাব নাই। দেশ ভর্তি দুষ্টু লোক- এই জইন্যে এই জিনিস।
রাজা : ও তাই বল। ওটা তাহলে সঙ্গেই রাখ–ফেলার প্রয়োজন দেখি না। তোমার নাম কি যেন বলছিলে?
চোর : মজনু। মাইনসে ডাকে মজনু চোরা।
রাজা : তোমাকে কিন্তু ভদ্রলোকের মতই দেখাচ্ছে, চোর বলে মনে হচ্ছে না।
চোর : [হেসে উঠবে]
রাজা : হাসছ কেন?
চোর : বেয়াদবী মাপ করেন হুজুর। এই কান ধরলাম আর যদি হাসি।
রাজা : না না ঠিক আছে। হাসতে ইচ্ছে হলে হাসবে। আমার অনুমতি লাগবে না।
চোর : হুজুরের দয়ার শরীর।
রাজা : রাজপ্রাসাদে পৌঁছেই তোমার জন্যে জায়গীরের ব্যবস্থা করব। পঞ্চাশ একর লাখেরাজ জমি। এতে চলবে?
চোর : হুজুরের অসীম দয়া।
রাজা : ঠিক আছে, ওটাকে একশ একর করে দিচ্ছি। একশ বিঘা লাখেরাজ জমি।
চোর : গোস্তাকী মাপ হয়। হুজুর কিন্তু বিঘার কথা বলেন নাই। হুজুর বলেছিলেন একশ একর।
রাজা : ও আচ্ছা। আমার কাছে বিঘাও যা একরও তা। তোমার যা পছন্দ তাই হবে। একশ একর।
চোর : হুজুর তাহলে চলেন, রওনা দেই। মেলা দূরের পথ।
রাজা : আমার পক্ষে হেঁটে যাওয়া সম্ভব নয়। জুতো হারিয়ে গেছে। কি করা যায় বল তো? এ তো একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াল।
চোর : হুজুর কি আমার পিঠে উঠতে চান?
রাজা : তোমার যদি কষ্ট না হয়। কষ্ট হবে? তোমার শরীরও তো খুব মজবুত মনে হচ্ছে না। অকারণে কষ্ট দিতে চাই না।
চোর :জ্বে না। কোন কষ্ট নাই। উঠেন হুজুর। [রাজা পিঠে চড়বেন] মাবুদে এলাহী, ওজন তো কম না।