বাবা কোথা থাকবে?
সেটা তোমার বাবা ঠিক করবে। তার যেখানে থাকতে ভাল লাগে সে সেখানেই থাকবে। বন্ধুর বাসায় থাকবে, কিংবা হোটেলে থাকবে। আবার একটা বাসা ভাড়া করেও থাকতে পারে।
বাবাকে কে বেঁধে দেবে?
রান্নার জন্যে সে কোন একটা লোক রাখবে। কিংবা নিজেই রাঁধবে। আজ সে নিজে রাঁধল না?
নুহাশ করুণ চোখে তাকিয়ে আছে। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। রেবেকা বলল, তোমার বাবা এবং আমি আমরা দুজন যদি আলাদা থাকি তাহলে সবার জন্যেই ভাল হয়। তোমার বাবার জন্যে ভাল হয়, কারণ তাহলে সে নিজের মত করে থাকতে পারে। বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দিতে পারে, ঘুরে বেড়াতে পারে, জোছনা দেখার জন্যে বনে জঙ্গলে থাকতে পারে। আমার জন্যে ভাল হয় কারণ আমিও তাহলে নিজের মত করে থাকতে পারি। আমাকে ঝগড়া করতে হয় না। তোমার বাবাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হয় না। তোমার জন্যেও ভাল হয়, কারণ তোমাকে তাহলে কোন ঝগড়া শুনতে হয় না। ঝগড়া শুনতে কি তোমার ভাল লাগে মা?
না।
কাজেই দেখ, তোমার জন্যেও ভাল হল। তোমাকে আর ঝগড়া শুনতে হবে না। এখন যাও হাত ধুয়ে দাঁত মেজে শুয়ে পড়। আমার বিছানায় শোও। এখন থেকে আমরা দুজন এক বিছানায় শোব।
হাত ধুতে ধুতে নুহাশ বলল, আমার একা ঘুমুতেই ভাল লাগে মা।
আমার সঙ্গে ঘুমুতে চাও না?
না।
তুমি কি আমার উপর রাগ করেছ নুহাশ?
না, আমি রাগ করি নি।
আমার তো মনে হয় করেছ।
না করি নি।
.
নুহাশের ঘুম আসছে না। কিন্তু ঘুমের ভান করে সে শুয়ে আছে। ঘরের কাজকর্ম সেরে অনেক রাতে মুনার-মা নুহাশের ঘরে ঘুমুতে এল। এই ঘরেই সে পাটি পেতে ঘুমুয়। নুহাশ মুনার-মাকে দেখে বিছানায় উঠে বসে নিচু গলায় বলল, বুয়া, আমার বাবা-মা কি ভাল মানুষ, না মন্দ মানুষ?
মুনার-মা হাই তুলতে তুলতে বলল, আল্লাহ পাকের দুনিয়ায় সব মানুষই ভাল। আবার সবই মন্দ। মানুষ বড় বিচিত্র গো আফা।
নুহাশের আরো কিছু কথা জিজ্ঞেস করার ছিল কিন্তু মুনার-মা ঘুমিয়ে পড়েছে।
একবার ঘুমিয়ে পড়লে তাকে জাগানো খুব মুশকিল।
নুহাশ স্কুলে
০৩.
নুহাশ স্কুলে যাবার জন্যে তৈরি হয়েছে। মুনারা-মা তাকে স্কুলে নিয়ে যাবে। নুহাশের কাঁধে বইয়ের ব্যাগ, হাতে পানির বোতল। মুনার-মাকে সে কিছু নিতে দেবে না। রিকশায় যাবার সময় মুনার-মা তাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে থাকে। তাতেও নুহাশের আপত্তি, সে বড় হয়েছে তাকে হাত ধরে ধরে রাখা যাবে না। তাছাড়া বুয়ার গা থেকে মশলার গন্ধ আসছে।
স্কুলের কাছাকাছি এসে নুহাশ বলল, স্কুলে যেতে ইচ্ছা করছে না বুয়া।
বাসায় চইল্যা যাবা?
হু।
আম্মায় হুনলে রাগ হইব।
অনেকদিন স্কুলে কামাই হয়েছে। আজও যদি না যাওয়া হয় তাহলে মা সত্যি সত্যি রাগ করবে। নুহাশের সঙ্গে রাগ করলে মা হৈচৈ বা বকাঝকা করে না–কথা বন্ধ করে দেয়, আর কেমন ঠাণ্ডা চোখে তাকিয়ে থাকে। এরচে বকাঝকা ছিল ভাল।
নুহাশ বলল, আমার বোধ হয় জ্বর আসছে। জ্বর নিয়ে কি স্কুলে যাওয়া উচিত?
না, উচিত না। দেখি জ্বর কেমন?
মুনার-মা গায়ে হাত দিল। গা ঠাণ্ডা। জ্বর নেই।
জ্বর আছে না বুয়া?
উঁহু, শইল ঠাণ্ডা।
শরীর ঠাণ্ডা হওয়াও এক ধরনের জ্বর। আসল জ্বরের চেয়েও খারাপ।
তা হইলে চল বাসায় যাই গিয়া।
বাসায় যেতেও ইচ্ছা করছে না।
মুনার-মা বিস্মিত হয়ে বলল, কই যাইতে চাও?
বাবার কলেজে চল না বুয়া। তুমি তো চেন। চেন না? মিনহাজের কলেজ মুনার-মা চেনে। কয়েকবার এসেছে। কিন্তু হুট করে নুহাশকে নিয়ে কলেজে উপস্থিত হওয়াটা কি ঠিক হবে? আম্মা শুনলে প্রচণ্ড রাগবে। নুহাশ বলল, চল না বুয়া।
রিকশা ভাড়া তো নাই। যামু ক্যামনে?
আমার কাছে টাকা আছে। আমি স্কুল ব্যাগে হরলিক্সের কৌটাটা নিয়ে এসেছি।
মিনহাজকে কলেজে পাওয়া গেল না। আজ তার ক্লাস ছিল এগারোটায়, কিন্তু সে দশদিনের আনড লিভ নিয়েছে। আগামী দশদিন আসার কোন সম্ভাবনা নেই। কলেজের একজন স্যার বললেন, তোমার বাবাকে কিছু বলতে হবে খুকী?
নুহাশ কাঁদো কাঁদো মুখে বলল, না।
বাসায় চলে যাও। নিশ্চয়ই তোমার বাবা এতক্ষণে বাসায় চলে গেছে।
আচ্ছা।
নুহাশ বাসায় গেল না। কলেজের করিডোরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তার কেন জানি মনে হচ্ছে-বাবা হুট করে কলেজে চলে এসে তাকে চমকে দেবে। এ রকম কতবার হয়েছে। আসার যখন কথা না, তখন বাবা এসে উপস্থিত। একবার তারা নানাবাড়ি গিয়েছে–জামালপুর। দুপুরের ট্রেনে গেছে। বাবা যায় নি। তার নাকি খুব জরুরি কাজ। সকালে কলেজে পরীক্ষার ডিউটি আছে। প্রিন্সিপ্যাল ছুটি দেবে না। এত মন খারাপ হল নুহাশের! ট্রেনে উঠল কাঁদতে কাঁদতে। মা বলল, বাবা সঙ্গে যাচ্ছে না তো কি হয়েছে। তার কাজ আছে। কাজেই সে যাচ্ছে না। বেড়ানোর চেয়ে কাজ বড় না?
নুহাশের নানা বাড়ি পৌঁছল সন্ধ্যাবেলা। বাড়িতে ঢুকে দেখে বাবা নানীজানের পালংকে পা তুলে হাসিমুখে সবার সঙ্গে গল্প করছে। নুহাশের দিকে তাকিয়ে বলল, তারপর তোমাদের কি খবর? নুহাশ এতই অবাক হল যে মুখ দিয়ে কথা বেরুল না। তার মনে হল এটা বোধ হয় স্বপ্ন। রেবেকা বলল ব্যাপার কি? মিনহাজ হাসতে হাসতে বলল, তোমাদের একটা সারপ্রাইজ দিলাম। পরীক্ষার ডিউটি অন্য একজনের ঘাড়ে চাপিয়ে সোজা চলে গেলাম বাস স্টেশনে। বাস করে এক ধাক্কায় জামালপুর। কি, সারপ্রাইজড হয়েছ?