আরে কি যে বল, দায়িত্ব অনুভব অবশ্যই করি।
না, কর না। সামান্যতম দায়িত্বও যদি থাকত তাহলে আমরা বাড়ি ফেরা মাত্র তুমি জিজ্ঞেস করতে, ডাক্তার নুহাশ সম্পর্কে কি বলল। জিজ্ঞেস করেছ?
জিজ্ঞেস করি নি কারণ তোমাদের মুখ দেখেই মনে হয়েছে, ডাক্তার বলেছেন–সব ঠিকঠাক আছে। ডাক্তার কোন অষুধপত্রও দেন নি। অষুধপত্র দিলে সঙ্গে থাকতো। সঙ্গে কিছুই নেই। শুধু নুহাশের হাতে এক টিন চকলেট।
রেবেকা স্বাভাবিক গলায় বলল, নুহাশের জন্মের সময়ের কথা মনে আছে?
কোন কথা বল তো?
নুহাশের জন্মের এক সপ্তাহ আগে তুমি যে দেশ ভ্রমণে বের হয়ে গেলে।
ও আচ্ছা। বাংলাদেশের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় হেঁটে যাওয়া টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া।
হ্যাঁ টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া। তুমি জানতে যে কোন দিন নুহাশের জন্ম হতে পারে। তা জেনেও আমাকে একা ফেলে তুমি তোমার সেই বিখ্যাত টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া ভ্রমণ শুরু করলে। কেন করলে?
এরও একটা ব্যাখ্যা আছে। সুন্দর ব্যাখ্যা। শুনলেই তোমার মনে হবে ঠিক ঐ সময়ে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া ভ্রমণ ছিল খুবই প্রয়োজনীয়।
ব্যাখ্যাটা শুনবে?
না। তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে এগারো বছর। এই এগারো বছর শুধু ব্যাখ্যাই শুনেছি। আর শুনতে ইচ্ছা করছে না। আমি খুব খুশি হব তুমি যদি এই বাসা ছেড়ে এখন চলে যাও। তোমাকে আগেও একবার বলেছি, আজও বলছি, আমি তোমার সঙ্গে বাস করতে পারব না।
এখন চলে যেতে বলছ?
হ্যাঁ এখনই চলে যেতে বলছি। যাবার সময় তোমার হাঙ্গেরিয়ান গোলাস নিয়ে যেও। এই বস্তু আমি খাব না। আমি আমার মেয়েকেও খেতে দেব না।
লঘু পাপে গুরু দণ্ড হয়ে যাচ্ছে না?
না। তোমাকে আমি শাস্তি দিচ্ছি না। তোমাকে আমি যা দিচ্ছি তা হচ্ছে মুক্তি।
রেবেকা উঠে দাঁড়াল। মুনার-মাকে বলল–খাবার যা রান্না হয়েছে একটা টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে নিয়ে আস। পুরোটা টিফিন ক্যারিয়ারে ঢুকাবে। এতটুকুও যেন না থাকে।
রেবেকা মিনহাজের সামনে টিফিন ক্যারিয়ার রেখে সহজ স্বাভাবিক গলায় বলল, এই নাও তোমারা খাবার। এখন যেখানে যেতে ইচ্ছে, যাও।
সত্যি সত্যি যেতে বলছ?
হ্যাঁ বলছি। তোমাকে দেখলেই আমার মেজাজ খারাপ হবে। ঝগড়া করব। এসব আর ভাল লাগছে না। তুমিও শান্তিতে থাক। আমাকেও শান্তিতে থাকতে দাও। দয়া করে এখন উঠ।
মিনহাজ উঠল। ক্লান্ত গলায় বলল, আচ্ছা যাচ্ছি। টিফিন ক্যারিয়ারটা থাকুক। খাবারটা ভাল হয়েছে। আমি মানুষ খারাপ কিন্তু ভাল রাঁধুনি।
টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে যাও।
আচ্ছা নিচ্ছি। মুখ এমন কঠিন করে রেখ না রেবেকা। যাবার সময় তোমার হাসিমুখে দেখে যাই। এই পৃথিবীতে হাসিমুখ দেখা দুর্লভ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আর কথা বাড়িও না। রাত হচ্ছে–রওনা হয়ে যাও।
নুহাশকে দেখে যাই।
ও ঘুমুচ্ছে। ওর ঘুম ভাঙানোর কোন প্রয়োজন দেখছি না।
আচ্ছা।
মিনহাজ টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে বের হয়ে গেল।
রাতে নুহাসশকে ঘুম থেকে তোলা হল রাতের খাবার খাওয়ার জন্যে।
নুহাশ বলল, বাবা কোথায় মা?
রেবেকা বলল, বাইরে গেছে।
নুহাশ বলল, বদরুল চাচার বাসায়?
হতে পারে, আমি জানি না।
নুহাশের প্রিয় খাবারের একটি হচ্ছে ডিম ভাজা। প্রিয় খাবারই তাকে দেয়া হয়েছে। নুহাশ বলল, বাবা যে রান্না করেছে সেটা একটু খাব মা।
ঐ খাবার ছোটদের জন্যে না।
তবু একটু খাব। অল্প একটু।
ঐ খাবার তোমার বাবা নিয়ে গেছেন।
নুহাশ বিস্মিত হয়ে তাকাচ্ছে। ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না। রেবেকা বলল, তোমাকে বলেছিলাম না, আজ রাতে খুব জরুরী কিছু কথা তোমাকে বলব।
হ্যাঁ বলেছিলে।
ভাত খেতে খেতে আমার কথাগুলি মন দিয়ে শোন। তোমার বাবা একজন ভাল মানুষ। শুধু ভাল মানুষ বললে কম বলা হয়। খুবই ভাল মানুষ। হাসি খুশি, পরোপকারী।
পরোপকারী কি মা?
পরোপকারী হচ্ছে যে অন্যের উপকার করে বেড়ায়। ঐ যে দেখ– তোমার বদরুল চাচার মার অসুখ হল। খবর পেয়ে সব কাজকর্ম ফেলে তোমার বাবা পড়ে রইল সেখানে। একে বলে পরোপকার। যে কথা বলছিলাম, তোমার বাবা একজন ভাল মানুষ। সবাই তাকে পছন্দ করে। তুমিও কর। কর না?
হ্যাঁ করি।
সবার কাছেই তোমার বাবা প্রিয়। আমার কাছেও এক সময় খুব প্রিয় ছিল।
এখন না?
না, এখন না। শুধু এখন না, অনেক দিন থেকেই প্রিয় না। তোমার সামনেই তো আমরা ঝগড়া করি। করি না?
বাবা তো ঝগড়া করে না।
তা ঠিক তোমার বাবা ঝগড়া করে না। সে হাসিমুখে আমার সামনে বসে থাকে। যখন আমি খুব কঠিন কথা বলি, সে হো হো করে হাসে। হো হো করে হাসার মানে হচ্ছে তোমার কথায় আমি কান দিচ্ছি না। তুমি যা ইচ্ছা বল। কিছুই যায় আসে না। এই করে সে আমাকে আরো রাগিয়ে দেয়। কাজেই হাসিমুখে সামনে বসে থেকেও সে কিন্তু আসলে ঝগড়া করছে। ঠিক বলছি না মা?
হ্যাঁ ঠিক বলছ।
দিন রাত ঝগড়া করতে করতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আর ঝগড়া করতে, রাগারাগি করতে ভাল লাগছে না। আমি ঠিক করেছি আমি এমন কিছু করব যাতে আর ঝগড়া না হয়। এটা ভাল না মা?
হ্যাঁ ভাল। খুব ভাল।
কি করলে আর কখনো আমাদের ঝগড়া হবে না বল তো নুহাশ?
আমি জানি না।
দুজন যদি আলাদা থাকি। মাঝে মাঝে তোমার বাবা আসবে। হৈচৈ, গল্পগুজব করবে। তোমাকে নিয়ে বেড়াতে যাবে। তারপর আবার চলে যাবে নিজের জায়গায়।