আচ্ছা।
তোমার হয়ত শুনতে ভাল লাগবে না। তবু শোনা দরকার।
আচ্ছা।
দেখি জ্বর আছে কি-না।
রেবেকা জ্বর দেখল। তার মুখ বিষণ্ণ হয়ে গেল। সে নিচু গলায় বলর, হুঁ, আবার জ্বর আসছে মনে হচ্ছে। কি হচ্ছে এসব? দুদিন পরপর জ্বর!
রেবেকা বাড়ি ফিরে দেখল বাড়িতে হুলস্থূল হচ্ছে। মিনহাজ রান্না করছে। মুনার-মা শুকনো মুখে একটু দূরে দাঁড়িয়ে। ঘরময় থালাবাটি ছড়ানো। খাবার টেবিলের উপর একটা বঁটি। সবজি কাটা হচ্ছে টেবিলে।
মিনহাজ হাসিমুখে বলল, রান্না করছি। রান্নাবান্না করে তোমার মন ভুলানোর চেষ্টা। কি রান্না হচ্ছে জান? হাঙ্গেরিয়ান গোলাস। অপূর্ব! একবার খেলে কোরমা পোলাও মুখে রুচবে না। কোরমা পোলাও মুখে দিয়ে থু করে ফেলে দেবে!
রেবেকা কিছু না বলে শোবার ঘরে ঢুকল। নহাশকে শুইয়ে দিল বিছানায়। নুহাশ বলল, মা আমি বাবার রান্না দেখব।
না তোমাকে বাবার রান্না দেখতে হবে না।
আমার দেখতে ইচ্ছে করছে মা।
অন্য আরেকদিন দেখবে।
রেবেকা শোবার ঘরের বিছানায় বসে আছে। তার মাথা ধরেছে। মিনহাজের ছেলেমানুষি হৈচৈ অসহ্য বোধ হচ্ছে। এরচে সে বন্ধুর বাড়িতে থাকলেই ভাল হত।
মুনার-মা এসে বলল, বাড়িওয়ালা আসছে। আপনের সঙ্গে কথা বলতে চায়।
রেবেকা বিরক্ত স্বরে বলল, আমার সঙ্গে কি কথা? নুহাশের বাবা ঘরে আছে। তার সঙ্গে কথা বলত বল।
বলছিলাম। উনি আপনের সাথে কথা বলতে চায়।
বসতে বল। আমি যাচ্ছি।
বাড়িওয়ালা সিদ্দিক সাহেব অন্য বাড়িওয়ালাদের মত না। তিনি বেশ দ্র। কথাবার্তায় অমায়িক। নতুন মাস শুরু হওয়া মাত্র ভাড়ার জন্যে তাগিদের পর তাগিদ পাঠানোর অভ্যাসও তাঁর নেই।
রেবেকা বলল, কেমন আছেন?
সিদ্দিক সাহেব বললেন, ভাল আছি।
কি ব্যাপার বলুন তো?
সিদ্দিক সাহেব বিব্রত গলায় বললেন, না, তেমন কোন ব্যাপার না। অকারণেই এসেছি বলতে পারেন।
অকারণে তো আসেন নি। নিশ্চয়ই কোন কারণে এসেছেন। বলুন…
বাড়িভাড়া নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছিলাম।
বাড়িভাড়া বাড়াতে চান?
আরে না, বাড়িভাড়া বাড়াব কেন? বছর বছর বাড়িভাড়া বাড়ানোর অভ্যেস আমার নেই। দুবছর তো আছেন আমার এখানে। দুবছরে বাড়িভাড়া বাড়িয়েছি?
না।
আমি এসেছি কারণ অনেক দিন বাড়িভাড়া দেয়া হয় না…
রেবেকা বিস্মিত হয়ে বলল, অনেক দিন বাড়িভাড়া দেয়া হয় না মানে? কত দিন দেয়া হচ্ছে না?
এই মাস নিয়ে পাঁচ মাসের ভাড়া বাকি পড়ল।
সে কি?
সিদ্দিক সাহেব বললেন, টাকাপয়সার সমস্যা সময় সময় হতেই পারে। হওয়াটাই স্বাভাবিক। না হওয়াটাই বরং বিচিত্র। তবু একসঙ্গে অনেক জমে গেলে…
আমি আগামীকালই আপনার বাড়িভাড়া মিটিয়ে দেব। এটা নিয়ে চিন্তা করবেন না।
না না, আমি চিন্তা করি না। আজ তাহলে উঠি।
সিদ্দিক সাহেব উঠে গেলেন। রেবেকা চোখে পানি এসে গেল। এ কি কাণ্ড! বাড়িভাড়া মিনহাজের দেয়ার কথা। রেবেকা সংসার চালানোর যাবতীয় খরচ দেয়। মিনহাজের শুধু বাড়িভাড়া, গ্যাস এবং ইলেকট্রিসিটির বিল দেবার কথা। সে যখন পাঁচ মাস বাড়িভাড়া দেয় নি। গ্যাস, ইলেকট্রিসিটির বিলও নিশ্চয়ই দেয় নি।
রেবেকা রান্নাঘরে ঢুকল। মিনহাজ কড়াইয়ে তেল চাপিয়েছে। সে খুব ব্যস্ত। পাঞ্জাবীর হাতা গুটিয়ে নিয়েছে। গুনগুন করে গানও গাওয়া হচ্ছে।
আজি এ বসন্তে
কত ফুট ফুটে
কত পাখি গায়…
রেবেকা শীতল গলায় বলল, গান বন্ধ কর। তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।
মিনহাজ হাসিমুখে বলল, তুমি কি বলবে তা আমি জানি। সিদ্দিক সাহেব এসেছিলেন সেই খবর পেয়েছি। পাঁচ মাস বাড়িভাড়া দেয়া হয়নি এই তো? এটা কোন বড় ব্যাপার না।
তোমার ধারণা খুবই তুচ্ছ ব্যাপার?
ইয়েস মাই ডিয়ার ইয়াং লেডি। আমার তাই ধারণা। আমি যখন পুরো ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করব তখন তোমারও তাই ধারণা হবে। তুমি বসার ঘরে বস। আমি রান্না শেষ করেই আসছি। দশ মিনিটের বেশি লাগবে না।
রেবেকা বসার ঘরে এসে চুপচাপ বসে রইল। মিনহাজ ঘরে ঢুকল আধ ঘণ্টা পর। মিনহাজের হাতে দুকাপ চা।
চা বানিয়ে আনলাম। চা খেতে খেতে আমার ব্যাখ্যা শোন। মুখ এমন গম্ভীর করে রাখার দরকার নেই। তুমি এমন ভাব করছ যেন নিকট আত্মীয় কেউ মারা গেছে। কেউ মারা যায় নি। সবাই ভাল আছে।
তুমি কি বলতে চাচ্ছ তাই বল।
ব্যাপার হল কি-বদরুলের মা অসুস্থ হয়ে পড়ল। বুড়ো বয়সে অসুখ বিসুখ হলে সিরিয়াস অবস্থা হয়। জোয়ানদের যেখানে একটা অষুধে কাজ হয় বুড়োদের সেখানে লাগে দশটা অষুধ। চিকিৎসার খরচ চালাতে গিয়ে বদরুলের অবস্থা হয়ে গেল কেরাসিন। কেরাসিনের চেয়েও খারাপ। বদরুলের অবস্থা হলে গেল পেট্রোল। আমি তাকে গত পাঁচ মাসের বাড়িভাড়ার টাকা দিয়ে সাহায্য করেছি।
জনসেবা?
জনসেবা না। জনসেবা করার ক্ষমতা আমার কোথায়? বন্ধুসেবা বলতে পার।
বাড়িভাড়া তুমি দিচ্ছ না এটা আমাকে জানাতে অসুবিধা ছিল?
ছিল। তুমি রাগ করতে। আমি তোমাকে রাগাতে চাচ্ছিলাম না। তবে তুমি কোন রকম চিন্তা করবে না। প্রভিডেন্ট ফান্ডের লোনের জন্যে দরখাস্ত করেছি। লোন গ্রান্টেড হয়েছে। চা খাচ্ছ না কেন, চা খাও।
রেবেকা চায়ের কাপ হাতে নিল না। শীতল গলায় বলল, নিজের সংসারের প্রতি, নিজের স্ত্রী এবং সন্তানের প্রতি তুমি কোন রকম দায়িত্ব অনুভব কর না। তাই না?