বগলে থামটার দেন দেহি আফা। জ্বরটা দেহি।
জ্বর তো তুমি দেখতে পার না। আমিও পারি না।
আপনে দেন দেহি।
নুহাশ থার্মোমিটার দিল। জ্বর বোধ হয় আরো বাড়ছে। কানের কাছে কেমন ভোঁ-ভোঁ শব্দ হচ্ছে। জ্বর খুব বেড়ে গেলে এমন শব্দ হয়। নুহাশ তার বাবার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। তার বাবা চারটার ভেতর চলে আসবেন। পাঁচটার সময় নুহাশকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেন। এরকম কথা হয়ে আছে। মা রোজ পাঁচটার মধ্যে চলে আসেন। চারটার সময় তাঁর অফিস শেষ হয়। বাসায় আসতে আসতে বাজে পাঁচটা। আজ মার আসতে দেরি হবে। কারণ অফিসের শেষে তিনি তাঁর অফিসের এক কলিগের বাড়িতে যাবেন। রাতে সে বাড়িতে তার খাবার দাওয়াত। কলিগ কি জিনিস নুহাশ জানত না। মাকে জিজ্ঞেস করে জেনেছে। মা বলেছেন, কলিগ হল সহকর্মী এক সঙ্গে যারা কাজ করে তারা সবাই কলিগ। নুহাশ বলেছে, তাহলে ভিখিরীরা সবাই কলিগ, তাই না মা?
উদ্ভট কথা বলবে না নুহাশ। উদ্ভট কথাবার্তা তুমি তোমার বাবার সঙ্গে বলো কিংবা তোমার ছোটচাচার সঙ্গে বলল, আমার সঙ্গে না। ভিখিরী হচ্ছে ভিখিরী। ওরা কাজ করে না।
মাকে নুহাশ অসম্ভব ভালবাসে। রেগে যখন মা তর্ক করেন তখন মাকে তার সবচে বেশি ভাল লাগে। এমিতেই মা খুব ফর্সা। রেগে গেলে গাল লাল টুকটুকে হয়ে যায়। তখন মাকে যা সুন্দর লাগে! বাবা রাগলে কেমন লাগে নুহাশ জানে না। কারণ বাবাকে সে কখনো রাগতে দেখি নি।
মা যখন খুব রেগে বাবার সঙ্গে তর্ক করেন তখনো বাবা হাসেন। হাসতে হাসতে বলেন, কোন লাভ নেই রেবেকা, তুমি আমাকে রাগাতে পারবে না। তুমি যত ইচ্ছা হৈচৈ কর, চেঁচামেচি কর, আমি শুধু মিটিমিটি হাসব। চেষ্টা করে দেখ। যদি সত্যি কোনদিন রাগাতে পার–তাহলে নগদ পাঁচশ টাকা পাবে। নগদ পাঁচশ দেব-সব চকচকে দশ টাকার নোট।
নুহাশের খুব ইচ্ছা করে বাবাকে রাগিয়ে চকচকে দশ টাকার নোটে নগদ পাঁচশ টাকা নিয়ে নেয়। টাকাটা পেলে সে হরলিক্সের কৌটায় রেখে দিত। কিন্তু বাবাকে রাগানো আসলেই মুশকিল-বুয়া একবার বাবার হাতঘড়ি টেবিল থেকে ফেলে ভেঙে ফেলল। বাবা সেই ভাঙা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন। মা রাগী গলায় বললেন, তুমি হাসছ কেন? দামী ঘড়ি ভেঙে ফেলেছে এর মধ্যে হাসির এলিমেন্ট কি আছে?
আছে। হাসির একটা এলিমেন্ট এর মধ্যেও আছে।
বল আমাকে, আমি জানতে চাই হাসির এলিমেন্টটা কি?
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখ- ঘণ্টার এবং মিনিটের কাঁটা ঠিক বারোটায়। অর্থাৎ ঘড়িরও বারোটা বেজেছে। হা হা হা …।
বাবা শব্দ করে হাসতে লাগলেন। ভাবটা এরকম যেন এমন মজার ব্যাপার তার জীবনে এর আগে ঘটে নি।
.
ছটা বেজে গেছে। নুহাশের বাবা সিটি কলেজের ইতিহাসের লেকচারার মিনহাজ উদ্দিন এখনো ফেরে নি। মুনার-মা মোড়ের ডিসপেনসারি থেকে এক ডাক্তারকে নিয়ে এসেছে। ডাক্তার সাহেব জ্বর দেখলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, একশ তিন পয়েন্ট পাঁচ।
পয়েন্ট পাঁচ ব্যাপারটা কি নুহাশ বুঝতে পারছে না। ডাক্তার সাহেবকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হচ্ছে। কিন্তু মনে হচ্ছে জিজ্ঞেস করলেই উনি রেগে যাবেন। কিছু কিছু মানুষ আছে প্রশ্ন করলেই রেগে যান। ডাক্তার সাহেবকে সেই রকম মনে হচ্ছে। তা ছাড়া উনি এমিতেই রেগে আছেন। রাগী রাগী গলায় বললেন, এমন অসুস্থ বাচ্চা ফেলে বাবা-মা দুজনই চলে গেলেন। এটা কেমন কথা? নুহাশের ইচ্ছে করছিল, বলে-উনারা যখন যান তখন আমার অসুখ ছিল না। কিন্তু সে কিছু বলল না। ডাক্তার সাহেব যখন বললেন, এখন কেমন লাগছে খুকী? সে বলল, ভাল লাগছে। আসলে তার ভাল লাগছিল না। খুব খারাপ লাগছিল। তবু সে মিথ্যা করে বলল, ভাল লাগছে। মিথ্যা বলাটা ঠিক হয় নি। মিথ্যা বললে পাপ হয়। তবে ছোটচাচা বলেছেন–সব মিথ্যায় পাপ হয় না। কিছু কিছু মিথ্যা আছে যেগুলি শুনলে মানুষ খুশি হয়। সেইসব মিথ্যায় পাপ হয় না। বরং খানিকটা পুণ্য হয়।
ডাক্তার সাহেব গম্ভীর মুখে বললেন, জ্বর কমানোর জন্যে অষুধ দিয়ে গেলাম। সিরাপ। তিন চামচ এখন খাও। ছঘণ্টা পর আবার তিন চামচ খাবে।
জ্বি আচ্ছা।
মাথায় পানি ঢালতে হবে। আর গা স্পঞ্জ করে দিতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত জ্বর একশ না হয়েছে ততক্ষণ পর্যন্ত মাথায় পানি ঢালতে হবে।
নুহাশ বলল, আপনার ভিজিট কত ডাক্তার সাহেব?
ডাক্তার সাহেব চমকে উঠে বললেন, কেন?
আমার কাছে টাকা আছে। হরলিক্সের কৌটায় আছে।
বাইরের কলে গেলে একশ টাকা ভিজিট নেই। তবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে কমও নেই। তোমার ক্ষেত্রে কম নেব।
কত?
এক টাকা দাও। পুরানো ময়লা নোট না। ঝকঝকে নোট দাও।
নুহাশ এক টাকার একটা নোট বের করল। ডাক্তার সাহেব হেসে ফেললেন। হাসতে হাসতে টাকাটা মানিব্যাগে রাখলেন। আশ্চর্য এত গম্ভীর একজন মানুষ কি সুন্দর করে হেসে ফেলল। তাহলে আজ দিনে নুহাশ কজনকে হাসাতে পারল? দুজনকে। আরো একজন বাকি রয়েছে।
ডাক্তার সাহেব বললেন, খুকী, আমি এখন যাচ্ছি। যা করতে বলছি করবে। আর রাত দশটার ভেতর যদি তোমার বাবা-মা কেউ না আসেন, আমাকে খবর দেবে।
খবর পেয়ে আপনি কি করবেন?
কি করব বুঝতে পারছি না। খুব খারাপ কিছু করে বসতে পারি। আমি আবার ভয়ংকর রাগী মানুষ। কাজের মেয়েটা গেল কোথায়? তাকে বললাম মাথায় পানি ঢালতে। সে করছে কী? এ বাড়ির সবাই দেখি খুব ঢিলাঢালা। এসব তো সহ্য করা যাবে না। ওর নাম কি?