শিল-পাটা ধার দিতে নুহাশ কখনো দেখে নি। আজ হয়ত দেখা যাবে। নুহাশ বলল, ধার দেবার যন্ত্রপাতি কোথায়?
আছে, যন্ত্রপাতি আছে। এই ব্যাগের মইদ্যে আছে।
বের করুন তো একটু দেখি।
লোকটা কিছু বের করতে পারল না। তার আগেই নুহাশদের কাজের মেয়ে-মুনার-মা ঘরে ঢুকে আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার দিল-আফা!
নুহাশ বলল, চিৎকার করছ কেন?
আপনেরে না আম্মা নিষেধ করছে–জানালা দিয়া কারো সাথে কথা বলন যাইব না। নিষেধ করছে না? বলেন করে নাই?
আমি তো অকারণে কথা বলছি না। কাজের কথা বলছি।
আপনার আবার কি কাজের কথা?
ঐ লোকটা খুব ভাল শিল-পাটা ধার করতে পারে। ব্যাগের মধ্যে তার সব যন্ত্রপাতি আছে। সে আমাদের শিল-পাটা ধার করবে।
মুনার মা লোকটার দিকে তাকিয়ে কর্কশ গলায় বলল, যান কইলাম। যান। এই বাড়িত শিল-পাটার কারবারই নাই-মসলা গুঁড়া হয় মেশিনে। যান কইলাম।
লোকটা বিব্রত ভঙ্গিতে বলল, খুকী আম্মা আমারে দশটা টেকা দিছেন।
মুনার-মা হতভম্ব গলায় বলল, ও আল্লা, এর মধ্যে টেকাও দিয়া দিছে। দেন, ফিরত দেন। টেকা ফিরত দেন কইলাম। বাচ্চা মানুষ পাইয়া টেকা নেওন। ছিঃ ছিঃ।
লোকটা মুখ করুণ করে দশ টাকার নোটটা এগিয়ে দিল। নুহাশ বলল, না, টাকা ফেরত দিতে হবে না।
মুনার মা বলল, এইটা কোন কথা হইল আফা? এক টেকা দুই টেকা হইলে একটা বিষয় ছিল। দশ টেকা। দশ টেকা কি সহজ জিনিস? দশ টেকা রোজগার করতে শইলের রক্ত পানি হইয়া যায়।
নুহাশ বলল, আমি বললাম টাকা ফেরত দিতে হবে না। সে জানালা দিয়ে গলা বের করে বলল, এই যে শুনুন। আপনি এখন চলে যান। আরেকদিন আসবেন-তখন আমরা শিল-পাটা ধার করাব। আমি পাশে বসে দেখব।
জ্বি আইচ্ছা আম্মা।
কাজটা কি খুব কঠিন?
কঠিন না, আবার ধরেন সহজও না। নিয়ম-কানুন আছে।
আমি কি শিখতে পারব?
অবশ্যই শিখতে পারবেন। তবে আম্মা এইসব ছোট কাজ আপনে কেন শিখবেন? আপনে শিখবেন-বড় বড় কাজ। ভাল কাজ।
কিন্তু আমি আপনারে শিখায়ে দিব।
কাজটা শেখা হয়ে গেলে আমিও মানুষের শিল-পাটা ধার করে বেড়াব।
লোকটা হেসে ফেলল। বোঝাই যাচ্ছে, সে খুশি হয়ে হাসছে। মুনার মা কঠিন গলায় বলল, জানালার সামনে খাড়াইয়া হাইসেন না। যান কইলাম। না যাইলে অসুবিধা আছে। মুনার-মা খট করে জানালা বন্ধ করে দিল।
নুহাস ক্ষীণ গলায় বলল, জানালা বন্ধ করছ কেন বুয়া?
আম্মা জানালা বন্ধ রাখতে বলছে। আম্মা আপনারে বলছে শুইয়া বিশ্রাম করতে। দুধ আনতেছি, খান। খাইয়া শুইয়া থাকেন।
দুধ খাবেন না।
এই কথা মুখেও আইনেন না আফা। দুধ আনতেছি, এক টান দিয়া দুধ শেষ করন লাগব।
মুনার-মা শুধু দুধ আনল না, একটা পিরিচে কয়েক টুকরা পেঁপেও নিয়ে এল। নুহাশের ধারণা পৃথিবীতে সবচে খারাপ খাবারের মধ্যে এক নম্বর হচ্ছে দুধ, দুনম্বর হল পেঁপে। তিন নম্বরে অনেকগুলি আছে-করলা ভাজি, শাকসবজি। অথচ এগুলি না-কি বেশি বেশি করে খেতে হবে। এগুলির মধ্যে নাকি সবচে বেশি ভিটামিন। খারাপ খারাপ জিনিসগুলির মধ্যে ভিটামিন থাকে আর ভাল জিনিসগুলির মধ্যে কেন থাকে না? এ রকম পচা নিয়ম কেন? আইসক্রিমের ভেতর যদি সবগুলি ভিটামিন থাকত তাহলে কত ভাল হত। সকালে, বিকেলে আর রাতে তিন বাটি আইসক্রিম খেয়ে ফেললে ঝামেলা শেষ।
নুহাশ এক টুকরা পেঁপে মুখে দিল। মনে হচ্ছে বমি হয়ে যাবে। সে দুধের গ্লাসে ছোট্ট করে চুমুক দিল। আজকের দুধটা অন্য দিনের চেয়েও খারাপ, সব ভাসছে। আজ মনে হচ্ছে বমি হবেই হবে। পেটের মধ্যে কেমন যেন করছে। ইশ, সে যদি তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যেতে পারত! বড়দের এসব খেতে হয় না। বড়রা তাদের ইচ্ছেমত খাবার খেতে পারে।
বুয়া।
কি?
তুমি ঐগুলি রেখে যাও। আমি পরে খাব।
না। আপনে আমার সামনে খাইবেন। মানুষে খাওন পায় না, ক্ষিধা পেটে পথে পথে ঘুরে, আর আপনে …।
জানালাটা খুলে দাও বুয়া।
না। আম্মা বইল্যা দিছে জানালা বন থাকব। জানালা কি মানুষ বন্ধ করে রাখার জন্যে বানায়? মানুষ জানালা বানায় খুলে রাখার জন্যে। টিভিতে খবরের সময় ওরা কি গান গায়–সব কটা জানালা খুলে দাও না।
আফা, দুধটা শেষ করেন তো। আফনে খালি ঝামেলা করেন।
বুয়া আমার বমি আসছে।
আসলে আসব। আফনে লম্বা একটা টান দেন।
নুহাশ দুধের গ্লাসে লম্বা টান দিল এবং তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বমি করে মেঝে ভাসিয়ে ফেলল। সে লজ্জিত গলায় বলল, তোমাকে বলেছিলাম না বুয়া আমার বমি হবে। এখন দেখলে তো ঘর কেমন নষ্ট হল। তোমারই তো কষ্ট হবে। পরিষ্কার করতে হবে।
দুপুরে নুহাশ কিছু খেল না। কারণ দুপুরে তার জ্বর এল। বেশ ভাল জ্বর। থার্মোমিটার দিলে একশ দুই কিংবা তিন হবে। বুয়া থার্মোমিটার দেখতে জানে না। নুহাশও জানে না। কিন্তু সে বুঝতে পারছে জ্বর অনেক বেশি। যখন জ্বর অনেক বেশি হয় তখন শরীর হালকা হয়ে যায়। কিন্তু মাথা হয়ে যায় ভারী। মনে হয় মাথাটা বিছানায় পড়ে আছে, আর শরীরটা আকাশে উঠে যাচ্ছে।
মুনার-মা শুকনো গলায় বলল, মাথায় পানি দিমু আফা?
না।
একটু দেই। শইল বেশি গরম ঠেকতাছে।
তাহলে দাও।
একজন ডাক্তার খবর দিয়া আনি আফা। আপনে একলা একলা থাকতে পারবেন?
ডাক্তার লাগবে না। বাবার আসার সময় হয়ে গেছে। সাড়ে তিনটা বাজে।
মুনার-মা ড্রয়ার থেকে থার্মোমিটার বের করে অনেকক্ষণ ঝাঁকিয়ে নুহাশের কাছে নিয়ে এল।