দেয়ালে টকটক শব্দ হচ্ছে। কে করছে? তাকালেও কিছু দেখা যাবে না, কারণ অন্ধকার। জমাট অন্ধকার। খাটের নিচে খচমচ শব্দ হচ্ছে কেন? নুহাশ চাপা গলায় বলল, কে? কে?
কেউ জবাব দিল না। খচমচ শব্দটাও এখন হচ্ছে না। নুহাশ বাতি জ্বালাল। তার ঘুম আসছে না। বিছানায় শুয়ে থাকতে ইচ্ছা করছে না। গল্পের বই পড়া যায়। কিন্তু মা সবগুলি গল্পের বই প্যাকেট করে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছেন। প্যাকেট এখনো ভোলা হয় নি।
খেলনাগুলি নিয়ে কিছুক্ষণ কি খেলবে? একা একা খেলতেও ইচ্ছা করছে না। এই এক আশ্চার্য ব্যাপার, কখনো একা খেলা যায় না। খেলার জন্যে সব সময় একজন কাউকে দরকার। বড়রাও খেলতে পারে। যেমন বাবা। বাবার সঙ্গে নুহাশ অনেক ধরনের খেলা খেলে। সবচে বেশি খেলে রান্নাবাটি। পৃথিবীতে যত খেলা আছে তার মধ্যে রান্নাবাটি খেলা হল সবচে ভাল খেলা। মিছিমিছি রান্না করতে হয়। মিছিমিছি রান্না খেয়ে মিছিমিছি বলতে হয়–রান্না খুব ভাল হয়েছে। এইসব কথা বলতে হয় সত্যের মত করে। বলার সময় হাসা যাবে না। বাবা খুব ভাল মিছিমিছি কথা বলেন। মনে হয় সত্যি কথা বলছেন। ঐদিন সে বাবার সঙ্গে রান্নাবাটি খেলা খেলল। নুহাশ বলল, ওগো তরকারীটা কেমন হয়েছে দেখ তো।
বাবা গম্ভীর হয়ে বললেন, ভাল হয়েছে। লবণ একটু কম হয়েছে। রঙটা এমন হলুদ হলুদ হল কেন? তরকারীতে রঙ না হলে আমি খেয়ে আরাম পাই না। হলুদ বেশি দিয়েছ না-কি? মরিচ বেশি দেয়া দরকার ছিল। তাহলে রঙ হত।
মরিচ ইচ্ছা করে কম দিয়েছি। মরিচ বেশি হলে বাচ্চারা খেতে পারে না।
ওদের জন্যে আলাদা রান্না করলেই পার।
আমি একা মানুষ। এক হাতে কদিক সামলাব?
কেন, কাজের ছেলেটা তো আছে।
ও কি কিছু জানে না-কি! হাত ধরে ধরে কাজ শেখাতে হচ্ছে। ঐদিন সেটের একটা কাপ ভেঙে ফেলল।
সে কি?
ভেঙেও আবার মিথ্যা কথা বলে। আমাকে বলে, আম্মা, আমি হাত দিয়া ছুঁইয়াও দেহি নাই।
কানে ধরে বার করে দাও। দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভাল।
তুমি তো বলেই খালাস। কানে ধরে বের করে দিলে আরেকটা পাব কোথায়? তোমার নিজের জন্যেই তো একজন ফুল টাইম কাজের লোক দরকার। দিনের মধ্যে দশবার সিগারেট আনাচ্ছ। আচ্ছা, তোমার সিগারেট যা লাগে এক সঙ্গে আনিয়ে রাখতে পার না? যতবার সিগারেট ধরাবে ততবার এক কাপ করে চা লাগবে। এত কিছু করলে আমি সংসার দেখব কিভাবে? আমার তো চারটা হাত না। দুটা মোটে হাত।…
নুহাশের চোখে প্রায় পানি এসে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে বাবার সঙ্গে আর কোনদিনও রান্নাবাটি খেলা যাবে না। কোনদিন না। কত দিন যে সে বাবাকে দেখে না। বাবার বিখ্যাত অনুস্বার কবিতা শুনে না। কি যে সুন্দর ঐ কবিতাটা।
নুহাশের চোখে এবার সত্যি সত্যি পানি এল। সে চোখ মুছে মেজোমামার দেয়া খেলনার প্যাকেট খুলতে বসল। এই প্যাকেটটা এখনো খোলা হয় নি। প্যাকেটে কি আছে সে জানে। আলাদিনের আশ্চার্য চেরাগ। তবে খেলনা চেরাগ। সত্যিকারের চেরাগ থাকলে তো ভাল হত। সে দৈত্যটাকে বলতো–তুমি এক্ষুণি বাবা-মাকে একসঙ্গে করে দাও। এক্ষুণি। এক্ষুণি। এক্ষুণি।
আলাদিনের চেরাটা বেশ ভারী। দেখে মনে হয় লোহার তৈরি। জায়গায় জায়গায় পাথর বসানো। ধরবার হাতলও আছে। নুহাশ বাত হাতে হাতল ধরে, ডান হাতে প্রদীপের একটা পাশ ঘষল। ওমি প্রদীপের মুখ দিয়ে প্রথমে সাদা ধোঁয়া, তারপর কালো ধোঁয়া বের হতে লাগল। শব্দ হতে লাগল কটকট, কটকট। নুহাশ যদি না জানত এটা একটা খেলনা প্রদীপ তাহলে অবশ্যই ভয়ে চিৎকার করে উঠত। সত্যিকার প্রদীপের ভেতর থেকে নিশ্চয়ই এরকমই কালো ধোঁয়া বের হয়।
ও আল্লা, ধোঁয়া তো বেরুচ্ছেই। আরো ঘন হয়ে বেরুচ্ছে। মনে হচ্ছে। ধোয়াটা জমাট বাঁধছে। জমাটবাঁধা ধোঁয়া দিয়ে মানুষের মত কি যেন তৈরি হচ্ছে। নুহাশ হাত থেকে খট করে প্রদীপ ফেলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে ধোঁয়া বের হওয়া বন্ধ হল। তবে ধোয়া জমাট বেঁধে মানুষের মত হয়ে গেল। মানুষের মত না, অবিকল মানুষ। শার্ট প্যান্ট পরা। চোখে চশমা, পকেটে একটা বল পয়েন্ট কলম। রোগা পটকা ধরনের একটা মানুষ। ধবধবে সাদা গায়ের রঙ। কিন্তু চুলের রঙ সোনালী। লোকটা বিরক্ত হয়ে বলল, খট করে প্রদীপটা যে ফেলে দিলে, এর মানে কি? ব্যথা লাগে না বুঝি?
নুহাশ আতঙ্কে অস্থির হয়ে বলল, তুমি কে?
লোকটা আরো বিরক্ত হয়ে বলল, তুমি তুমি করছ কেন? আপনি করে বল।
আপনি কে?
আমি কে তা তো বুঝতেই পারছ। তুমি তো কচি খুকী না। আমি হলাম আলাদিনের চেরাগের দৈত্য।
নুহাশ অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, আপনাকে দৈত্যের মত লাগছে না।
চেহারা দিয়ে দৈত্য বোঝা যায়? দৈত্যের পরিচয় হল ক্ষমতায়। বল তোমার কি চাই। দেরি করবে না। ঝটপট বল। ঝটপট!
যা চাই তাই দিতে পারবেন?
বোকার মত কথা ভুলবে না। যা চাইবে তাই কি করে দেব? আকাশের চাঁদ চাইলে কি এনে দিতে পারব? চাঁদের ওজন কত জান? পাঁচ দশমিক সাত গুণন টেন টু দি পাওয়ার আঠারো কিলোগ্রাম।
আপনি কি সত্যি সত্যি আলাদিনের দৈত্য?
অবশ্যই। চেরাগের ভেতর ধোয়া হয়ে শুয়ে থাকি। কেউ ঘষলে বের হয়ে আসি। খুকী, তোমার কাছে চিরুনি আছে? চুলটা আঁচড়ে নেয়া দরকার। এলোমেলো হয়ে আছে।
নুহাশ চিরুনি বের করে দিল। দৈত্য চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলল, চট করে বল তোমার কি দরকার। এনে দিচ্ছি। আজগুবি কিছু চেয়ে বসবে না। কৎবেল খেতে চাও? কৎবেল খেতে চাইলে কোন গাছ থেকে একটা পেড়ে নিয়ে আসব। তবে বৃষ্টি হলে পারব না। বৃষ্টি হয়ে গাছ পিছল হয়ে থাকে। গাছে উঠতে পানি না।