বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। মিনহাজ বৃষ্টিতেই নেমে গেল। এগুতে লাগল ভিজতে ভিজতে। রেবেকার একটু খারাপ লাগছে। এই খারাপ লাগাকে প্রশ্রয় দেয়া ঠিক না। শেকসপিয়ারের একটা কথা আছে। হ্যামলেট বলছিল– I have to be cruel, only to be kind. রেবেকা তাই করছে। এর বেশি কিছু না।
.
দুদিন পর মিনহাজ আবার এল।
এবার তার হাতে কুড়িটা টাটকা গোলাপ। এক বাক্স চকলেট, এবং একটা বার্বি ডল। কলিং বেল টিপতে গিয়ে দেখল-দরজায় বিরাট তালা ঝুলছে। জানালা-টানালা সব বন্ধ। তবু অভ্যাস বসে তিন-চার বার কলিং বেল টিপল। কোন শব্দ হল না।
মিনহাজ গেল বাড়িওয়ালা সিদ্দিক সাহেবের কাছে। সিদ্দিক সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, ওরা যে চলে গেছে আপনি জানেন না?
জ্বি-না।
সে কি! দুদিন ধরে মাল নেয় হচ্ছে। আজ সকালে বিছানা বালিশ নেয় হল। বাড়ি ছাড়ার সময় আপনার মেয়েটা খুব কাঁদছিল। এমন কান্না! দেখে আমার নিজের চোখেও পানি এসে গেল।
মিনহাজ কি বলবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। সিদ্দিক সাহেব বললেন বাড়ি যে ছেড়ে দেবে সেটা তো জানতেন?
মিনহাজ ইতস্তত করে বলল– জ্বি জানতাম।
কোথায় গেছে সেই ঠিকানা আছে না?
জ্বি আছে।
সেখানে চলে যান। আমিও একবার যাব। ঠিকানা জানি না অবশ্যি। আপনি বলুন, ঠিকানাটা লিখে নেই। আপনার মেয়েটার জন্য মন কাঁদছে– একদিন গিয়ে দেখে আসব।
মিনহাজ বলল, জায়গাটা চিনি-মালিবাগের দিকে। ঠিক অ্যাডড্রেস জানি না। জেনে এসে আপনাকে লিখে দিয়ে যাব।
সিদ্দিক সাহেবের বাড়ি থেকে বের হয়ে মিনহাজ দীর্ঘ সময় পার্কে একা একা বসে রইল। দুপুরে চকলেটের টিন মাথায় নিচে দিয়ে পার্কের বেঞ্চিতে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখল-নুহাশকে নিয়ে সে পার্কে বেড়াতে এসেছে। নুহাশ তার কাঁধে। একদল বাচ্চাকাচ্চা তাদের ঘিরে আছে। সে অনুস্বার কবিতা পড়ছে। বাচ্চারা খুব মজা পেয়ে হাততালি দিচ্ছে, এবং মুখে বিচিত্র শব্দ করছে। যেমন :
মিনহাজ : নুহাশ আবাবুটিং
বাচ্চারা : টিং টিং টিং
মিনহাজ : গোলটা চক্ষুং
বাচ্চারা : উং উং উং।
মিনহাজ : খুব হাসটুং
বাচ্চারা : টুং টুং টুং
মিনহাজ : ফিকফিকিং
বাচ্চারা : ইং ইং ইং
অ্যাপার্টমেন্টটা খুব সুন্দর
০৫.
অ্যাপার্টমেন্টটা খুব সুন্দর না নুহাশ?
হ্যাঁ সুন্দর!
তাহলে এমন মন খারাপ করে আছ কেন? নতুন অ্যাপর্টমেন্টে আসার পর একবারও হাসলে না। দেখি সোনা হাস তো?
নুহাশ হাসল।
তোমার ঘরটা কত সুন্দর তাকিয়ে দেখ। জানালা খুললে কত বাতাস। তার চেয়েও বড় কথা-জানালা খুললে পুরো আকাশটা দেখা যায়। আকাশ দেখতে পাচ্ছ?
পাচ্ছি।
আকাশটা সুন্দর না?
হ্যাঁ সুন্দর।
দেখ কত বড় বড় দুটা ক্লসেট তোমার ঘরে। একটাতে থাকবে তোমার খেলনা। একটায় বইপত্র। পড়ার টেবিলটা থাকবে জানালার পাশে। পড়তে পড়তে যদি আকাশ দেখতে ইচ্ছা করে তাহলে শুধু মুখ তুলে তাকালেই হবে।
নুহাশ হাই তুলল। তার কিছু ভাল লাগছে না।
আবার এই দেখ, ঘরের সঙ্গে বাথরুম। এই বাড়িটার সবচে ভাল জিনিস কি বল তো নুহাশ?
জানি না।
সবচেয়ে ভাল জিনিসটা হচ্ছে বাথরুম। দেখ, ঘরের সঙ্গে লাগোয়া কি সুন্দর বাথরুম। সুন্দর না?
নুহাশ মায়ের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, মা, বাবা কি এই বাড়ির ঠিকানা জানে?
রেবেকা চট করে জবাব দিতে পারল না। ইতস্তত করে বলল, দেখা হলে আমি তাকে ঠিকানা দিয়ে দেব। তখন জানবে।
কবে দেখা হবে?
হবে, শিগগিরই হবে। এসো তো নুহাশ, আমরা তোমার বাথরুমটা দেখি। এখানে গরম পানির ব্যবস্থা আছে।
আমার বাথরুম দেখতে ইচ্ছা করছে না।
রাতে কিছু রান্না হয় নি। রেবেকা প্যাকেটে করে চাইনীজ খাবার নিয়ে এসেছে। মুনার-মা মুখ বিকৃত করে সেই খাবারই টেবিলে সজিয়ে দিচ্ছে। বিড়বিড় করে বলছে, মানুষ এই জিনিস ক্যামনে খায়বদ গন্ধ আসতাছে। ওয়াক থু।
নুহাশ খাবার টেবিলে বসে হঠাৎ করে বলল, মা আমার ভাল লাগছে না।
রেবেকা বলল, কি ভাল লাগছে না?
বাবা থাকবে এক জায়গায়, তুমি থাকবে আরেক জায়গায়, এটা আমার ভাল লাগছে না মা।
সব কিছু তোমার ভাল লাগামত করতে হবে তা তো না। তাছাড়া কোনটা ভাল, কোনটা মন্দ তাও তুমি জান না। ভাল-মন্দ বোঝার বয়স তোমার হয় নি। ওকি, খাচ্ছ না কেন?
আমার খেতে ইচ্ছা করছে না।
খেতে ইচ্ছা না করলে হাত ধুয়ে উঠে যাও। খাবার নাড়াচাড়া করবে না।
নুহাশ টেবিল ছেড়ে উঠে গেল। নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। রেবেকা দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলল, এ কি নুহাশ, দরজা বন্ধ করছ কেন? নুহাশ জবাব দিল না। রেবেকা বলল, একা তুমি ঘুমুতে পারবে না। রাতে ভয় পাবে। মুনার-মা ঘুমুবে তোমার সঙ্গে।
নুহাশ জবাব না দিয়ে বাতি নিভিয়ে দিল।
তুমি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছ নুহাশ। খুব বাড়াবাড়ি করছ। একটু পরেই আমিও দরজা বন্ধ করে ঘুমুতে যাব। তখন ভয় পাবে।
নুহাশ জবাব দিল না।
রেবেকা বাতি নিভিয়ে ঘুমুতে গেল।
চারিদিক অন্ধকার
০৬.
চারিদিক অন্ধকার।
নুহাশের ভয় ভয় লাগছে। ভূতের সব কটা গল্প একমঙ্গে মনে পড়ছে। মনে হচ্ছে খাটের নিচে ঘাপটি মেরে একটা কন্ধকাটা ভূত বসে আছে। পৃথিবীতে যত ভূত আছে-কন্ধকাটা হল তার মধ্যে সবচে ভয়ঙ্কর। এর মাথা নেই। শরীরটা বিশাল কিন্তু হাত দুটি সেই তুলনায় খুব সরু, প্রায় সুতার মত। কথা বলে ফিসফিস করে।