নুহাশের ধারণা, বেশ কিছুক্ষণ কলেজের করিডোরে দাঁড়িয়ে থাকলে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্যে বাবা এসে উপস্থিত হবে।
মুনার-মা বলল, চল যাই গিয়া। কতক্ষণ খাড়াইয়া থাকবা?
আচ্ছা চল।
নুহাশের মনে হল সে অনেকদিন বাবাকে দেখছে না, অনেক অনেক দিন। আজ দেখা হলে খুব ভাল হত। অনুস্বার কবিতাটা শোনা যেত। বাবা নুহাশকে নিয়ে একটা কবিতা বানিয়েছে। কবিতার নাম অনুস্বার কবিতা। খুব জটিল কবিতা। এমিতে মানে বোঝা যায় না। কিন্তু মানে আছে।
নুহাশ আব্বুটিং
(নুহাশ আব্বু)
গোলটা চক্ষুং
(তার চোখ গোল)
হাসটুং করছিং
(সে হাসি করছে অর্থাৎ হাসছে)
ফিকফিকিং
(ফিকফিক করে)
হাসটুং দেখং, আদর লাগছিং
(হাসি দেখে আদর লাগছে)
নুহাশ জ্বর নিয়ে ফিরল। এতে সে এবং মুনার-মা দুজনই বেশ খুশি হল। মাকে আর মিথ্যা বলতে হবে না। সত্যি সত্যি জ্বর এসেছে।
জ্বর হওয়া নুহাশের অভ্যাস হয়ে গেছে। খারাপ লাগে না বরং চাদর গায়ে দিয়ে জানালার কাছে বসে থাকতে ভাল লাগে। মুনার-মা বলল, কিছু খাইবেন আফা?
না।
সরবত বানাইয়া দেই, লেবু দিয়া?
উঁহু।
জ্বর তাইলে কমব।
সরবত খেলে জ্বর কমবে না। জ্বর কেন হয় তা কি তুমি জান মুনার মা?
জানব না ক্যান? আল্লাহ্ পাক জ্বর দেয় বইল্যাই জ্বর হয়।
দূর। আল্লাহ্ এমন খারাপ জিনিস আমাদের দেবেন কেন? উনি দেবেন। ভাল ভাল জিনিস।
জ্বর খারাপ জিনিস না আফা। জ্বর ভাল জিনিস। জ্বর হইলে পাপ কাটা যায়।
কি যে অদ্ভুত অদ্ভুত কথা তুমি বল বুয়া।
পুব দিকের জানালা খোলা। জ্বর গায়ে নুহাশ জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে আছে। দুটি ভিখিরী মেয়ে ঠিক জানালার নিচে খেলা করছে। অদ্ভুত খেলা। একজন অন্যজনকে ঠেলছে এবং খিলখিল করে হাসছে। এই খেলার নাম বোধ হয় ঠেলাঠেলি খেলা। নুহাশ ডাকল-অ্যাই অ্যাই। ওরা দুজনও একই সঙ্গে বলল–অ্যাই অ্যাই। বলে হেসে একজন অন্যজনের গায়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। এত আনন্দ এদের!
দুপুরে এল শিল-পাটা ধার করানোর মানুষটা। নুহাশের তখন জ্বর বেড়েছে। সে শুয়ে আছে চাদর গায়ে জড়িয়ে। এখন তার কিছুই ভাল লাগছে না। দেয়ালগুলিকে মনে হচ্ছে অনেক বেশি শাদা। চোখে লাগছে। শিল-পাটা ধার করানোর লোকটা ঠিক তার জানালার কাছে এসে মিষ্টি করে বলছে–শিল-পাটা ধার করাইবেন? শিল-পাটা। অবিকল যেন একটা গান। গান শুনতে শুনতে নুহাশ ঘুমিয়ে পড়ল। যখন ঘুম ভাঙল তখন বিকেল। নুহাশের গায়ে জ্বর নেই। শরীর ঝরঝরে। খুব খিদে হয়েছে। ঘুম ভেঙেই সে শুনল মা কার সঙ্গে যেন উঁচু গলায় কথা বলছেন। কার সঙ্গে? বাবা কি চলে এসেছে? নুহাশ কান পেতে রাখল। না–বাবা আসে নি। মেজোমামা।
নুহাশের একজনই মামা। তিনি নুহাশের মার চেয়ে বয়সে দশ বছরের বড়। তবু নুহাশ কেন তাকে মেজোমামা ডাকে সে নিজেও জানে না।
তার নাম জাহেদুল করিম। বিমানের পাইলট। বেশির ভাগ সময় দেশের বাইরে থাকেন। খুব গম্ভীর ধরনের মানুষ। তবু কেন জানি নুহাশের তাকে খুব ভাল লাগে। তিনি এ বাড়িতে আসার মানেই হল–কোন-না-কোন উপহার নুহাশের জন্যে নিয়ে এসেছেন। তিনি খালি হাতে এ বাড়িতে এসেছেন এমন দুর্ঘটনা এখন পর্যন্ত ঘটে নি।
মেজোমামার সঙ্গে মা ঝগড়া করছে কেন? বড় ভাইদের সঙ্গে কখনো কি ঝগড়া করা যায়? যায় না। নুহাশের কোন বড় ভাই থাকলে সে কখনো তার সঙ্গে ঝগড়া করত না। বড়দের ঝগড়া ছোটদের শোনা উচিত না–তবু নুহাশ শুনছে। কারণ মা কেন ঝগড়া করছে তা জানতে ইচ্ছে করছে।
মেজোমামা : (গলা খুব গম্ভীর) তুই বলতে চাচ্ছিস যে তোদের অ্যাডজাস্টমেন্ট হচ্ছে না? [অ্যাডজাস্টমেন্ট ব্যাপারটা কি নুহাশ বুঝতে পারছে না। এক সময় মাকে জিজ্ঞেস করতে হবে।
মা : না অ্যাডজাস্টমেন্ট হচ্ছে না। অতীতেও হয় নি, ভবিষ্যতেও হবে না। আমরা দুজন দুই মেরুর মানুষ। [মেরুর মানুষ আবার কি? এস্কিমো?]
মেজোমামা : তুই তবে চাস কি?
মা : আমি ঠিক করেছি ওর সঙ্গে বাস করব না।
মেজোমামা : বাস করব না বলতে কি মিন করছিস? [মিন করছিসটা আবার কি?]
মা : আমি সেপারেশন নেব ভাইয়া। আমি নুহাশকে নিজের মত করে মানুষ করব।
মেজোমামা : সেপারেশন নিবি?
মা : হ্যাঁ নেব। সেপারেশন ছাড়া পথ নেই। [সেপারেশন কি নুহাশ জানে। তাদের ক্লাসের একটি মেয়ে মিথিলার বাবা-মার সেপারেশন হয়েছে। বাবাটা অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করেছে। সেই মেয়েটা একদিন স্কুলে এসেছিল। ও আল্লা দেখতে কি যে কুৎসিত!]।
মেজোমামা : চট করে বলে ফেললি সেপারেশন?
মা : চট করে তো বলি নি ভাইয়া। আমি এটা নিয়ে তিন বছর চিন্তা করেছি। তোমাদের কাউকে কিছু বলি নি। ওর সঙ্গে থাকলে আমি পাগল হয়ে যাব।
মেজোমামা : আমার তো ধারণা তুই এখনি পাগল হয়ে গেছিস… কথা শোন রেবেকা! ব্যাপারটা হল কি…
মা : তুমি আমাকে কিছু বুঝাতে এসো না ভাইয়া। লাভ হবে না। আমি আজ অফিসে যাই নি। এক লইয়ারের কাছে গিয়েছি। ওকে উকিলের চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছি।
মেজোমামা: কি বললি?
মা : বুঝতে পারছি–তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না। উকিলের চিঠির কপি আমার কাছে আছে। দেখতে চাইলে দেখতে পার।
মেজোমামা: আই সি।
মা : ভাইয়া চা খাবে?
মেজোমামা : না, চা খাব না। নুহাশকে দেখে চলে যাব। তোর অবগতির জন্যে জানাচ্ছি- নুহাশের বাবাকে আমি অসম্ভব পছন্দ করি।