- বইয়ের নামঃ নুহাশ এবং আলাদিনের আশ্চর্য চেরাগ
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ আফসার ব্রাদার্স
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
শিল-পাটা
জানালার কাছে কে একজন চেঁচাচ্ছে শিল-পাটা ধার করাইবেন? শিল-পাটা ধার। লোকটার গলার স্বর খুব মিষ্টি, মনে হচ্ছে গান গাচ্ছে। কেমন টেনে টেনে বলছে শিল-পাটা ধা—- র।
নুহাশের বিছানা জানালার পাশে। সে ‘সাত ভূতের কাণ্ড’ নামের একটা বই পড়ছিল। বই ফেলে জানালার শিক ধরে দাঁড়াল। উঁচু গলায় ডাকল, অ্যাই অ্যাই।
লোকটা অবাক হয়ে তাকাল। রোগা একজন মানুষ। পরনে সবুজ রঙের লুঙ্গি, গায়ে ময়লা গেঞ্জি। হাতে ছোট্ট একটা পুঁটলি। লোকটা বিস্মিত হয়ে বলল, শিল-পাটা ধার করাইবেন?
নুহাশ বলল, হ্যাঁ করাব। আপনি আসুন। কাছে আসুন।
লোকটা কাছে আসছে না। মনে হয় নুহাশকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না। নুহাশের বয়স মাত্র নয়। হলি ক্রস স্কুলে ক্লাস ফোরে পড়ে। আজ তাদের স্কুল খোলা। সে স্কুলে যায় নি। গতকালও যায় নি, তার আগের দিনও না। কারণ নুহাশের শরীর ভাল না। গত দুদিন জ্বর ছিল। আজ অবশ্যি জ্বর নেই।
নুহাশ বলল, কাছে আসছেন না কেন? কাছে আসুন।
লোকটা এগিয়ে এল। অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বলল, শিল-পাটা ধার করাইবেন?
নুহাশের খুব মজা লাগছে। লোকটা তার সঙ্গে কেমন আপনি আপনি করে কথা বলছে। কেউ তাকে আপনি বলে না। ক্লাস ওয়ান, ক্লাস টু-র মেয়েগুলিও না। কিন্তু ওদের তো আপনি বলা উচিত। সে বয়সে তাদের চেয়ে বড়।
শিল-পাটা ধার করাইবেন?
হ্যাঁ করাব।
দশ টেকা লাগব।
দশ টাকাই দেব। আমার কাছে টাকা আছে।
লোকটা মনে হল তার কথা বিশ্বাস করছে না। কেমন করে যেন তাকাচ্ছে। ছোটদের কোন কাজে বিরক্ত হলে বড়রা যে রকম করে তাকায়, সে রকম করে তাকাচ্ছে। সে বোধহয় ভাবছে-এই মেয়েটির টাকা নেই। সে মিথ্যা কথা বলছে। নুহাশের টাকা কিন্তু আছে। জমানো টাকা। হরলিক্সের কাচের বৈয়মে ভরা। প্রথমে সে টাকাগুলি রেখেছিল তার ছোট্ট কাঠের বাক্সটায়। ছোটচাচা বললেন, ও কি নুহাশ! টাকা কেউ এভাবে রাখে? টাকা রাখতে হয় এমনভাবে যেন সবাই দেখতে পায়। টাকা দেখতেও আনন্দ আছে। কাচের বৈয়মে ভরে রাখ।
টাকা দেখলে আনন্দ হয় কেন চাচা?
টাকা হচ্ছে ফুলের মত। কিংবা কে জানে হয়ত ফুলের চেয়েও সুন্দর। এখন বুঝবি না। বড় হয়ে বুঝবি।
ছোটচাচা কথাবার্তাই এ রকম। কিছু বলেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলবে, সারগর্ভ বাণী দিলাম। এই বাণীর মর্ম এখন বুঝবি না। বড় হয়ে বুঝবি।
নুহাশ বড় হবার জন্যে অপেক্ষা করছে। বড় হতে আর কতদিন লাগবে কে জানে। এস.এস.সি. পাস করার পর কি বড় হয়? ছোটচাচাকে জিজ্ঞেস করেছিল। চাচা বললেন, কত বছর বয়সে বড় হয় এটা বলা খুব মুশকিল। ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। কেউ কেউ দশ বছরেই বড় হয়ে যায়। আবার কেউ কেউ আছে নব্বই বছরেও হয় না। বয়স যত বাড়ে বুদ্ধিশুদ্ধি তত কমে।
ছোটচাচা কথার কোন আগামাথা নেই। নুহাশের বাবার ধারণা–তাঁর ভাইটির মাথায় ব্রেইন বলে কোন পদার্থ নেই। মাথাটা সাবানের ফেনা দিয়ে ভর্তি। তাও গায়ে-মাখা সাবানের ফেনা না। কাপড়-ধোয়া সাবানের ফেনা। কে জানে হতেও পারে। বাবা তো আর মিথ্যা কথা বলবেন না। জেনেশুনেই বলেছেন। তাছাড়া বাবা হলেন টিচার। টিচাররা মিথ্যা বলতে পারে না। নিয়ম নেই।
লোকটা সরু চোখে তাকিয়ে আছে। এবার সে নিঃশ্বাস ফেলে চলে যেতে ধরল। নুহাশ বলল, ও কি চলে যাচ্ছেন কেন? আপনাকে তো বলেছি। আমার কাছে দশ টাকা আছে। হরলিক্সের কৌটায় ভরা আছে। দাঁড়ান, এনে দিচ্ছি। চকচকে টাকা নেবেন, না ময়লা টাকা নেবেন? আমার কাছে দুটা দশ টাকার নোট আছে–একটা চকচকে নোট, একটা ময়লা।
লোকটা জবাব দিল না। নুহাশ হরলিক্সের কৌটা খুলে চকচকে নোটটাই বের করল। চকচকে নোট পেলে সবাই খুশি হয়। লোকটাও খুশি হবে। লোকটা খুশি হলে হেসে ফেলবে। ছোটচাচা বলেছেন, শোন নুহাশ, তুই যদি সারাদিনে তিনজন মানুষকে হাসাতে পারিস তাহলে ধরে নিতে হবে–তুই অসাধারণ একজন মানুষ।
মাত্র তিনজনকে হাসাতে পারলেই হবে?
হ্যাঁ মাত্র তিনজন। কিংবা একজনকেই তিনবার। সময়সীমা হচ্ছে। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত।
তিনজনকে হাসানো তো খুব সহজ চাচা।
মোটেই সহজ না। ভয়ংকর কঠিন কাজ। গল্প বলে হাসাননা নয়। তুই এমন কোন কাজ করবি যা দেখে খুশি হয়ে মানুষটা হাসবে। যত সহজ ভাবছিস তত সহজ না। কঠিন কর্ম। পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে যারা সারাজীবনেও একজনকে খুশি করতে পারে নি।
কাজটা যে কঠিন নুহাশ এখন তা জানে। যেমন আজ সে এখন পর্যন্তু কাউকে হাসাতে পারেনি। সকাল এগারোটা বাজে, দিনের অর্ধেক তো চলেই গেল। নুহাশ জানালা দিয়ে চকচকে নোটটা বের করে রেখেছে, কিন্তু লোকটা হাসছে না। নুহাশ বলল, নিন। নিচ্ছেন না কেন?
ধার করাইবেন?
অবশ্যই করাব।
লোকটা হাত বাড়িয়ে টাকা নিল। নুহাশ বলল, খুব ভাল করে ধার করবেন।
অবশ্যই ভাল কইরা ধার দিমু আম্মা। অবশ্যই দিমু।
শিল-পাটা ধার ব্যাপারটা কি নুহাশ জানে না। ছুরি কাঁচি ধার দেয়া হয় তা সে জানে। সে দেখেছেও–চাকতির মত একটা জিনিস আছে, রিকশা যেভাবে প্যাডেল করা হয়, সেভাবে প্যাডেল করে জিনিসটা ঘুরানো হয়। বঁটি, ছুরি, কাঁচি, চাকতির কাছে ধরলেই আগুনের ফুলকি বের হয়। এর নাম ধার দেয়া।