আজ করিম সাহেব ঘুম থেকে উঠে দেখেন পুষ্প তার আগেই উঠে বসে আছে। কেরোসিনের চুলায় চাল ফুটছে। তিনি খুশী গলায় বললেন, তুই এত সকাল সকাল উঠলি যে। রাতে ঘুম ভাল হয় নাই?
হয়েছে।
সকালে উঠে ভাল করেছিস মা। সুন্দর করে কয়েকটা পরোটা বানিয়ে ফেল। উনি রাতে না খেয়ে ঘুমিয়েছেন। ক্ষিধে নিয়ে ঘুম ভাঙ্গবে। গোত পরোটা দিবি। আর একটা ডিম ভেজে দিম।
তুমি থাকবে না বাবা?
না। একদিন কামাই হয়ে গেছে। অংক হল প্রাকটিসের ব্যাপার। পরপর দুই দিন কামাই দিলে সব ভুলে যাবে। সব গরু গাধার দল।
একা একা উনার কাছে নাশতা নিয়ে যাব বাবা?
হুঁ।
আমার কেন জানি ভয়-ভয় করে। কি গম্ভীর। কাল রাতে একটা কথাও বললেন না। আমি জানি আজও বলবেন না। নাশতাও খাবেন না। তাছাড়া আমার। পরোটাও ভাল হয় না বাবা।
তুই একটা ভুল করছিস মা। এই সব মানুষ খাওয়া-খাদ্য নিয়ে মোটেই মায়া ঘামায় না। তুই পোলাও-কোৰ্মা দিলে যেভাবে খাবেন, ডাল-ভাত দিলেও একইভাবে খাবেন। কিছুক্ষণ পর তুই যদি জিজ্ঞেস করিস, কি দিয়ে খেলেন? বলতে পারবে না। হা করে তাকিয়ে থাকবে।
পুষ্প হেসে ফেলল।
করিম সাহেব বললেন, হাসছিস কেন?
তুমি যেভাবে কথা বলছ তাতে মনে হয়–এই রকম মানুষ তুমি কত দেখেছ! আসলে এই প্রথম দেখছ।
দেখতে হয় না মা। আন্দাজ করা যায়।
ভদ্রলোককে তোমার কি খুব পছন্দ হয়েছে?
পছন্দ হবে না, কি বলিস তুই? নিজে যা ভাল মনে করেন তাই করেন। কাল রাতের কথা চিন্তা কর–অন্য কেউ হলে কি করত? শরীর যত খারাপই হোক দুমুঠ ভাত খেত। আমাদের খুশী করার জন্য করত। উনি তা করলেন না। কে খুশী হল কে হল না তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই।
পুষ্প হাসতে হাসতে বলল, উনি যদি খারাপ কিছু করেন, তুমি তারও একটা ভাল ব্যাখ্যা বের করবে।
তাতো করবই। কারণ খারাপ কিছু করার ক্ষমতাই এঁদের নেই। সৃষ্টিশীল মানুষ হচ্ছে ঈশ্বরের মত। ঈশ্বর যেমন মন্দ কিছু করতে পারে না, এঁরাও পাবেন না।
উনাকে দেবতা ডাকলে কেমন হয় বাবা?
ডাকতে পারিস কোন অসুবিধা নেই, তবে মনে মনে ডাকাই ভাল। রেগে যেতে পারেন। এই জাতীয় মানুষদের রাগ বেশী থাকে।
বাবা নামাজ শেষ করে আস। তোমার ভাত হয়ে গেছে। শুকনো মরিচ ভেজে দেব?
দে।
ভাত খেতে খেতে তিনি পুষ্পকে একগাদা উপদেশ দিয়ে গেলেন। বার বার খোঁজ নিয়ে আসবি উনার ঘুম ভাঙ্গল কি না। ঘুম ভাঙ্গতেই চা দিবি, তারপর বলবি আমার কথা।
তোমার কথা কি বলব?
ঐ যে স্কুলে গেলাম, সন্ধ্যার পর ফিরব। উনি দুপুরে কি খেতে চান জিজ্ঞেস করবি। মতির মার খোঁজ নিবি। আমি জেলে পাড়ায় বলে যাব ওরা মাছ দিয়ে যাবে।
বাবা উনি যদি বলেন, তোমাদের এখানে খাব না। বাবুর্চির ব্যবস্থা করতে বলেছিলাম–সেই ব্যবস্থা করে দাও।
তাহলে বলবি, বাবা এসে ব্যবস্থা করবেন। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শান্ত করবি।
বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কি ভাবে শান্ত করব? উনিতো ছেলেমানুষ না।
এই ধরনের মানুষের স্বভাব-চরিত্রে ছেলেমানুষ থাকে।
কোত্থেকে যে তুমি এইসব ধারণা পেয়েছ কে জানে।
উনি তো ঘরে আছেনই। আমার কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলিয়ে নে।
আচ্ছা মিলিয়ে নেব।
আর শোন মা, উনি যদি ঘুরতে-টুরতে যেতে চান। নিয়ে যাবি।
কাদার মধ্যে কোথায় ঘুরবেন?
কাদা পানি এই সব নিয়ে এঁদের কোন মাথা ব্যথা নেই। আমরা সাধারণ মানুষরা এইসব নিয়ে মাথা ঘামাই। এই বুঝি পায়ে কাদা লেগে গেল, এই বুঝি হাত নোংরা হল। যাদের মন পরিষ্কার তারা শরীরের নোংরা নিয়ে মাথা ঘামান না। মন যাদের নোংরা, শরীর পরিষ্কারের জন্যে তাদের চেষ্টার শেষ নাই।
আমি তো এই দলে পড়ে যাচ্ছি বাবা। নোংরা আমি সহ্য করতে পারি না। আমার মন কি নোংরা?
করিম সাহেব থমত খেয়ে গেলেন। হাত ধুতে ধুতে বললেন, এইটা একটা কথার কথা বললাম। আমি রওনা হয়ে যাচ্ছিগো মা। মতির মাকে খবর দিতে ভুলবিনা।
পিরিচ দিয়ে ঢাকা চায়ের কাপ হাতে দরজার ওপাশে পুষ্প বেশ কিছুক্ষণ হল দাড়িয়ে আছে। কেন জানি তার অসম্ভব ভয় করছে। সে প্রায় অস্পষ্ট গলায় বলল, আপনার চা। ভেতরে আসব?
শওকত সাহেব কিছু বললেন না। নিজে উঠে দরজা খুলে দিলেন। পুষ্প ঢুকল। তিনি বললেন, কেমন আছ পুষ্প? তাঁর গলার স্বর এত আন্তরিক যে পুষ্প হকচকিয়ে গেল। শওকত সাহেব চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বললেন, কাল রাতে আমি তোমাকে একটা ভুল কথা বলেছিলাম। আমি বলেছিলাম ধুতুরা ফুল বিষাক্ত। এটা ভুল। ধুতুরা ফুল বিষাক্ত না। শাদা এবং নীল মেশানো ফুল। খুব সুন্দর। ধুতরার ফল বিষাক্ত। ফুল নয়।
পুষ্প নীচু গলায় বলল, আমি জানি।
জান তাহলে রাতে বললে না কেন?
পুষ্প আগের চেয়েও মৃদু গলায় বলল, বলেছি। মনে মনে বলেছি।
মনে মনে বলেছ মানে?
পুষ্প মুখ নীচু করে বলল, কেউ যখন ভুল কথা বলে তখন আমি মনে মনে বলি, কথাটা ভুল। মুখে কিছু বলি না।
কাউকেই বল না?
খুব যারা প্রিয় তাদের বলি।
এরকম খুব প্রিয় মানুষ তোমার কজন আছে?
পুষ্প জবাব দিল না। তিনি আবার বললেন, প্রশ্নটার জবাব দাও। মনে মনে বলতে হয় না সরাসরি বলা যায় এমন প্রিয় মানুষ তোমার কজন আছে?
নেই।
তোমার বাবা। তিনিতে আছেন।
পুষ্প চুপ করে রইল। তিনি শান্ত গলায় বললেন, বাবা কি তোমার খুব প্রিয় নন?
হ্যাঁ প্রিয়, খুবই প্রিয়।
তবু ঠিক সে রকম প্রিয় নয়? তাই-কি?
স্যার আমি আপনার জন্যে নাশতা নিয়ে আসি। রাতে খান নি, আপনার নিশ্চয়ই খুব ক্ষিধে পেয়েছে।