করিম সাহেব বললেন, স্যার হাতটা ধুয়ে ফেলেন। রাততো অনেক হয়েছে। আপনার নিশ্চয়ই ক্ষিধে লেগেছে।
শওকত সাহেব বললেন, আপনি কিছু মনে করবেন না। আমি রাতে খাব না।
সেকি?
শরীর ভাল লাগছে না।
ভাল না লাগলেও চারটা খাওয়া দরকার। রাতে না খেলে শরীরের এক ছটাক রক্ত চলে যায়।
রক্ত চলে গেলেও কিছু করার নেই। আমার যা ভাল লাগেনা আমি কখনোই তা করি না।
কিছুই খাবেন না স্যার?
না।
পুষ্প মৃদুস্বরে বলল, এক গ্রাস দুধ দিয়ে যাই?
না-দুধ আমি এমিতেই খাই না। রাতে যদি ক্ষিধে লাগে আমার সঙ্গে বিস্কিট আছে। ঐ খেয়ে পানি খেয়ে নেব। আমার সম্পর্কে আর কিছুই চিন্তা করতে হবে না।
করিম সাহেব বললেন, খাবারটা ঢাকা দিয়ে রেখে যাব?
না। ভাত তরকারী পাশে নিয়ে ঘুমুতে ভাল লাগবে না।
করিম সাহেব মেয়ের দিকে তাকালেন। বেচারী মুখ কালো করে ফেলেছে। আহা কৃত আগ্রহ নিয়ে সে রান্না বান্না করেছে। নীচে ফিরে গিয়ে নিশ্চয়ই কাঁদবে।
করিম সাহেব বললেন, আর কিছু না খান। এক টুকরা ভাজা মাছ কি খাবেন? ডুবা তেলে ভাজা।
ডুবা তেলেই ভাজা হোক আর ভাসা তেলেই ভাজা হোক আমি খাব না। আমার একেবারেই ইচ্ছে করছে না।
পিতা এবং কন্যা বের হয়ে গেল।
দুজন অসম্ভব মন খারাপ করেছে। ঘর থেকে বেরুবার আগে পুষ্প এক। পলকের জন্যে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল শওকত সাহেবের দিকে। এবারের চোখের দৃষ্টি আগের মত নয়। সম্পূর্ণ অন্য রকম। চোখের মণিতে হ্রদের জলে আকাশের ছায়া। যে আকাশে মেঘের পরে মেঘ জমেছে।
শোবার ঘরটা শওকত সাহেবের খুব পছন্দ হয়েছে। হলঘরের মত বিরটি ঘর। দুপাশেই জানালা। জানালা দুটিও বিশাল। এক সঙ্গে অনেকখানি আকাশ দেখা যায়। কালো রঙের প্রাচীন খাট। খাটে বিছানো চাদর থেকে ন্যাপথলিনের গন্ধ। আসছে। খাটের পাশের টেবিলে কেরোসিনের টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে। টেবিল ল্যাম্পের এই আলোতেও এক ধরনের রহস্য আছে। বাতাসের সঙ্গে আলো কাপছে। সেই সঙ্গে কাঁপছে দেয়ালের ছায়া। মশা নেই বলেই বোধ হয় মশারি নেই। কতদিন পর তিনি মশারি ছাড়া ঘুমুচ্ছেন। নিজেকে কেমন যেন মুক্ত মানুষ বলে মনে হচ্ছে।
অষ্টাঙ্গ সংগ্রহ তার হাতে। ঘুমুবার আগে আরো কয়েকটা পাতা ওল্টানো যাক। বইটিতে ঘুমুবার নিয়ম কানুনও দেয়া আছে।
আটবার শ্বাস নিতে যেই সময় লাগে সেই সময় পর্যন্ত চিৎ হইয়া তাহার দ্বিগুণ সময় ডান পার্শ্বে, তাহার চারগুণ সময় বাম পার্শ্বে শয়ন করিয়া তারপর যেইভাবে শুই আরাম পাওয়া যায় সেইভাবে শুইতে হয়। নাভির বাম দিকে অগ্নি অবস্থান করে। সুতরাং বাম পার্শ্বে শয়ন করা উচিত।
তিনি ঠিক বই-এর মত নিয়মে শোবার চেষ্টা করলেন। যদিও খুব ভালমতই। জানেন যে ভাবেই শোয়া হোক রাত কাটবে নিঘুম। এখন পর্যন্ত নতুন জায়গায় প্রথম রাতে তিনি কখনো ঘুমুতে পারেন নি। নিঘুম রাত কাটাতে তার খারাপ লাগে। না। বরং বলা চলে ভাল লাগে। ভাববার সময় পাওয়া যায়। আজকাল কোন কিছুর জন্যেই সময় বের করা যায় না। একান্ত ভাববার জন্যে যে সময় সব মানুষের দরকার সেই সময় কি আমরা দিতে পারি? কর্মক্লান্তি দিনের শেষে লম্বা ঘুম, আবার ব্যস্ত দিনের শুরু।
জেগে থাকার এক ধরনের গোপন ইচ্ছা ছিল বলেই বোধ হয় অল্প সময়ের ভেতর ঘুমে তাঁর চোখ জড়িয়ে এল। ঘুমিয়ে তিনি বিচিত্র একটি স্বপ্ন দেখলেন।
এই ঘরেই খাটে তিনি শুয়ে আছেন। তার মন কি কারণে অসম্ভব খারাপ। বুকের ভেতর এক ধরনের কষ্ট হচ্ছে। এমন সময় দরজা খুলে গেল। হারিকেন হাতে ঢুকলো পুষ্প। পুষ্পকে কেমন বড় বউ দেখাচ্ছে। তিনি খানিকটা হকচকিয়ে গেছেন। এই গভীর রাতে মেয়েটি তাঁর ঘরে কেন? পুষ্প হারিকেন টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বলল, তুমি এখনো ঘুমাও নি?
তিনি অসম্ভব চমকে উঠলেন। মেয়েটি তাকে তুমি তুমি করে বলছে কেন?
পুষ্প খুব সহজ ভঙ্গিতে খাটে পা ঝুলিয়ে বসল। অভিমানী গলায় বলল, আচ্ছা শেন, তুমি এত ভুল কথা বল কেন?
তিনি মনের বিস্ময় চাপা দিয়ে বললেন, ভুল কথা কি বললাম?
ধুতরা ফুল বুঝি বিষাক্ত? মোটেই বিষাক্ত নয়। ধুতরার ফল বিষাক্ত। বুঝলেন জনাব?
বুঝলেন জনাব বলে পুষ্প খুব হাসছে। খুব পা নাড়াচ্ছে। কে? এই মেয়েটা কে? হচ্ছে কি এসব?
তাঁর ঘুম ভেঙ্গে গেল। সবে ভোর হয়েছে। গাছে গাছে অসংখ্য পাখি ডাকছে।
মোফাজ্জল করিম সাহেব
মোফাজ্জল করিম সাহেব ফজর ওয়াক্তে ঘুম থেকে উঠেন।
হাত মুখ ধোয়ার আগেই চুল ধরিয়ে ভাতের হাড়ি চাপিয়ে দেন। ওজু করে নামাজ শেষ করতে করতে চাল ফুটে যায়। মাড় গেলে আগুন-গরম ভাতে তিন চামুচ ঘি ঢেলে খাওয়া শুরু করেন। খাওয়া শেষ হতে হতে সূর্য উঠে যায়। তিনি রওনা হয়ে যান স্কুলে। স্কুল তাঁর বাড়ি থেকে আড়াই মাইল। বর্ষাকালে নৌকায় অনেক ঘুরপথে যেতে হয়। দুই থেকে আড়াই ঘণ্টার মত লাগে। স্কুলে পৌঁছতে হয় আটিটার আগে। যারা এবার এস.এস.সি দিচ্ছে তাদের স্পেশাল কোচিং হয়। আটটা থেকে দশটা। তাঁর উপর দায়িত্ব হল অংক এবং ইংরেজীর। আগে শুধু অংক করাতেন। নলিনীবাবু দেখতেন ইংরেজী। নলিনীবাবুর হাঁপানির টান খুব বেড়ে যাওয়ায় কিছুদিন ধরেই আসছেন না। করিম সাহেবের উপর ডাকল দায়িত্ব পড়ে গেছে। খুব চাপ যাচ্ছে। স্কুল থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। সন্ধ্যায় বাসায় ওসি সাহেবের এক শলা পড়তে আসে। মহা মূৰ্খ। এক মাস টেন্দ পড়াবার পর জিজ্ঞেস করলেন, আমি বাড়ি যাই ইংরেজী কি? সে পাঁচ মিনিট চিন্তা করে বলল I am home going. তিনি প্রচন্ড থাবড়া দিলেন। সে আগের চেয়েও গম্ভীর গলায় বলল, I home going. তাঁর ইচ্ছা করছিল শক্ত আছাড় দেন। একে বলে। পন্ডশ্রম।