মনে হয় খুব অলস ধরনের মানুষ।
অলস ধরনের মানুষ এইভাবে বসে থাকে না। শুয়ে ঘুমায়।
বাবা, আমি কি এই কাপড়টা পরে যাব না বদলাব?
বদলে ভাল শাড়ি পর। হাত মুখটা ধুয়ে নে।
উনি আবার ভাববেন নাতো যে উনার সঙ্গে দেখা করার জন্যে, শাড়ি বদলে সেজেগুজে গেছি।
কিছুই ভাববেন না। এই ধরনের মানুষ–কে কি পরল, না পরল, কে সাজল কে সাজল না এইসব নিয়ে মোটেও মাথা ঘামান না। তাদের অনেক বড়। ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করতে হয়। ছোট ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করার সময়ই তাদের নেই।
কিন্তু বাবা উনিতো ঔপন্যাসিক। ঔপন্যাসিকরা নিশ্চয়ই এইসব ব্যাপার খুব খুঁটিয়ে দেখেন। না দেখলে লিখবেন কি করে?
সেটাও একটা কথা। তাহলে থাক, কাপড় পাল্টানোর দরকার নেই।
না বাবা কাপড় পাল্টে যাই। আমাকে দশ মিনিট সময় দাও বাবা, গোসল করে ফেলি।
জ্বর গায়ে গোসল করবি?
রান্না বান্না করেছি। গা কুট কুট করছে।
আবার তো সব ঠাণ্ডা হবে।
আবার গরম করব। বাবা, আরেকটা কথা, আমি কি উনাকে পা ছুঁয়ে সালাম করব?
শওকত সাহেব বারান্দা ছেড়ে ঘরে ঢুকেছেন।
সুটকেস খুলে দেখছেন বেনু জিনিসপত্র কি দিয়ে দিয়েছে। এক গাদা বই থাকবে বলাই বাহুল্য। ঢাকায় বই পড়ার সময় তেমন হয় না। বাইরে এলে বই পড়ে প্রচুর সময় কাটান। রে তার নিজের পছন্দের বই এক গাদা দিয়ে দেয়। তার মধ্যে মজার মজার কিছু বই থাকে। যেমন এবারের বইগুলির মধ্যে একটা হল–অষ্টাঙ্গ সংগ্রহ। গ্রন্থ পরিচয়ে লেখা–আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের মূলতত্ত্ব বিষয়ক গ্রন্থ। এই বই দেয়ার মানে কি? রে কি তাকে আয়ুর্বেদে পণ্ডিত বানাতে চায়?
তিনি কয়েক পাতা ওল্টালেন। বিচিত্র সব কথাবার্তা বইটিতে লেখা–
পান খাওয়ার নিয়ম ঃ পূর্বাহ্নে সুপারি অধিক দিয়া, মধ্যাহ্নে খয়ের অধিক দিয়া ও রাত্রে চূন অধিক দিয়া পান খাইতে হয়। পানের অগ্রভাগ, মূলভাগ, ও মধ্যভাগ বাদ দিয়া পান খাইতে হয়। পানের মূল ভাগ খাইলে ব্যাধি, মধ্যভাগে আয়ুক্ষয় এবং অগ্রভাগ খাইলে পাপ হয়। পানের প্রথম পিক বিষতুল্য, দ্বিতীয় পিক দুর্জর, তৃতীয় পিক সুধাতুল্য উহা খাওয়া উচিত।
স্যার আসব?
শওকত সাহেব তাকিয়ে দেখেন করিম সাহেব তার মেয়েকে নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। দুজনের হাতে দুটি ট্রে। রাতের খাবার। পেছনে পেছনে আরেকজন আসছে। তার হাতে, পানির জগ, গ্লাস, চিলুমচি।
করিম সাহেব বললেন, স্যার আমার মেয়ে–পুষ্প। আমার একটাই মেয়ে। ময়মনসিংহে থাকে। হোস্টেলে থেকে পড়ে। এইবার আই—এ দেবে। পরীক্ষার ছুটি দিয়েছে। ও ভেবেছিল হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করবে। আমি বললাম, মা চলে আয়। একা একা থাকি। সে চলে এসেছে। চলে আসায় খুবই ক্ষতি হয়েছে। ঘর সংসার সবই এখন তার দেখতে হয়। এখন ভাবছি হোস্টেলে দিয়ে আসব।
পুষ্প মেঝেতে ট্রে রেখে এগিয়ে এসে পা ছুঁয়ে সালাম করল। শওকত সাহেব খানিকটা বিব্রত বোধ করলেন। কদম্বুসি করলে মাথায় হাত দিয়ে আশীবাদের কিছু কথা বলার নিয়ম আছে। তিনি কখনো তা পারেন না।
পুষ্প বলল, স্যার আপনার শরীর কেমন?
মেয়েও বাবার মতই তাঁকে স্যার ডাকছে। প্রশ্ন করেছে বোকার মত। তিনি যদি এখন–শরীর ভাল, না বলে বলেন–শরীর খুবই খারাপ তাহলেই মেয়েটি হকচকিয়ে যাবে। পরের কথাটা কি বলবে ভেবে পাবে না।
তিনি তাকিয়ে আছেন পুষ্পের দিকে।
মেয়েটিকে অস্বাভাবিক রকমের স্নিগ্ধ লাগছে। স্নান করার পর পর ক্ষণস্থায়ী যে স্নিগ্ধতা চোখে মুখে ছড়িয়ে থাকে সেই স্নিগ্ধতা। মেয়েটি কি এখানে আসার আগে স্নান করেছে। সম্ভবত করেছে। চুল আদ্র ভাব। মেয়েটির গায়ের রঙ অতিরিক্ত ফর্সা। শুধুমাত্র ফর্সা রঙের কারণে এই মেয়েটির ভাল বিয়ে হবে। মেয়েটার মুখ গোলাকার। মুখটা একটু লম্বাটে হলে ভাল হত। একে কি রূপবতী বলা যাবে? হুঁহ্যাঁ যাবে। মেয়েটি রূপবতী তবে আকর্ষণীয় নয়। রূপবতীদের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে কিন্তু কাছে যেতে ইচ্ছে করে না। যারা আকর্ষণীয়া তারা নিজেদের দিকে প্রবল ভাবে আকর্ষণ করে।
মোফাজ্জল করিম সাহেব বললেন, ওর নাম স্যার আসলে পুষ্প না। ওর ভাল নাম নাজনীন। আমরা ডাকতাম নাজু। একদিন ওর বড় মামা এসে বললেন, নাজু, ফাজু আবার কি রকম নাম। এত সুন্দর মেয়ে–এর নাম হল পুষ্প। সেই থেকে পুষ্প নাম।
শওকত সাহেব কেন জানি বিরক্তি বোধ করছেন। পিতা এবং কন্যা আগ্রহ নিয়ে তার সামনে বসে আছে। এরা তার কাছ থেকে মুগ্ধ ও বিস্মিত হবার মত কিছু শুনতে চায়। এমন কিছু যা অন্য দশজন শুনাবে না, তিনিই বলবেন। এক ধরনের অভিনয় করতে হবে। অন্যদের থেকে আলাদা হবার অভিনয়। আশে পাশের মানুষদের চমৎকৃত করতে হবে। পৃথিবীর সব বড় মানুষরাই গ্রহের মত। তাদের আশে পাশে যারা আসবে তারাই উপগ্রহ হয়ে গ্রহের চারপাশে পাক খেতে হবে। কোন মানে হয় না।
মেয়েটা এসেছে। আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। তাঁকে কিছু একটা বলতে হবে। ইন্টারেস্টিং কিছু কিছুই মাথায় আসছে না। তিনি এক ধরনের যন্ত্রণা বোধ করছেন।
তিনি থেমে থেমে বললেন, পুষ্প খুব ভাল নাম। তবে পূষ্প না হয়ে কোন। বিশেষ ফুলের নামে নাম হলে আরো ভাল হত। অনেক আজে বাজে ধরনের ফুলও কিন্তু আছে। যেমন ধুতুরা ফুল। বিষাক্ত ফুল। আবার কুমড়া ফুলও ফুল, সেই ফুল আমরা বড়া বানিয়ে খাই।
পুষ্প তাকিয়ে আছে। এক পলকের জন্যেও চোখ সরাচ্ছে না। মেয়েটির চোখে এক ধরনের কাঠিন্য আছে। সতেরো আঠারো বছরের মেয়ের চোখে এ। জাতীয় কাঠিন্যতো থাকার কথা না। এদের চোখ হবে হ্রদের জলের মত। স্বচ্ছ, গভীর এবং আনন্দময়।