টেবিলের উপর রেখে দিন।
আপনার খাবার কি স্যার নিয়ে আসব?
অতিথিরা চলে যাক। তারপর আনবেন। আমি বেশ রাত করে খাই। যদি সম্ভব হয় এক কাপ চা পাঠাবেন।
জি আচ্ছা।
চিনি বেশী করে দিতে বলবেন। আমি চিনি বেশী খাই।
জ্বি আচ্ছা।
মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রথম দর্শনে বাড়িটা যত খারাপ লেগেছিল এখন তা। লাগছে না। ভাল লাগছে। শুধু ভাল না। বেশ ভাল লাগছে। তিনি বসে আছেন বারান্দায়। বারান্দায় এই অংশে রেলিং আছে বলে বসে থাকতে কোন রকম অস্বস্তি বোধ করছেন না। তাঁর সামনে গোল টেবিল। টেবিলের উপর কুরুশ কাঁটার টেবিল ক্লথ। টেবিলের ঠিক মাঝখানে ফুলদানীতে চাঁপা ফুল। মিষ্টি গন্ধ আসছে সেখান থেকে। বৃষ্টি থেমে আকাশ পরিষ্কার হওয়ায় অসংখ্য তারা ফুটেছে। ঢাকার আকাশে তিনি কোনদিন এত তারা দেখেন নি। আকাশের তারার চেয়েও তাঁকে মুগ্ধ করেছে জোনাকী পোকা। মনে হচ্ছে হাজার হাজার জোনাকী ঝাক বেঁধে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাচ্ছে। দৃশ্যটা এত সুন্দর যে। মহাকবি বজলুর রহমানের মত চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছা করে–পাগল হয়ে যাব।
চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় দূরের নদী দেখা যাচ্ছে অস্পষ্টভাবে। চাঁদের আলো ঘোলাটে নয়, পরিষ্কার। এই আলোয় কেমন যেন জল জল ভাব আছে।
সবচে যা তাঁকে বিস্মিত করল তা হচ্ছে–নীরবতা। কোন রকম শব্দ নেই। ঘরে একটা তক্ষক আছে। তক্ষকটা মাঝে মাঝে ডাকছে। শব্দ বলতে এই। তিনি ভেবেছিলেন, যেহেতু বর্ষাকাল চারদিকে অসংখ্য ব্যাঙ ডাকবে। তা ডাকছে না। এই অঞ্চলে কি ব্যাঙ নেই?
মোফাজ্জল করিম সাহেব হাতে কেরোসিনের টেবিল ল্যাম্প নিয়ে উঠে এসেছেন। ল্যাম্পটা বেশ বড়। কাঁচের চিমনী ঝকঝকে পরিষ্কার। প্রচুর আলো আসছে।
স্যার ওসি সাহেব, আপনার জন্য টেবিল ল্যাম্পটা পাঠিয়েছেন। আপনি নিশ্চয়ই রাতে লেখালেখি করবেন। হারিকেনের আলো কম। টেবিল ল্যাম্প আপনার ঘরে দিয়ে আসি?
জি দিয়ে আসুন।
আপনার চা একবার বানিয়েছিল তিতা হয়ে গেছে। আবার বানাচ্ছে।
ঠিক আছে। কোন তাড়া নেই। আচ্ছা করিম সাহেব আপনাদের এদিকে ব্যাঙ ডাকে না?
ডাকে তো। ডাকবে না কেন? ব্যাঙের ডাকে ঘুমাতে পারি না এই অবস্থা।
আমি কিন্তু এখন পর্যন্ত শুনিনি।
তাই নাকি। বলেন কি?
শওকত সাহেব হেসে বললেন, ব্যাঙ না ডাকার জন্যে আপনাকে খুব লজ্জিত বলে মনে হচ্ছে।
মোফাজ্জল করিম কি বলবেন ভেবে পেলেন না। ব্যাঙ না ডাকায় তার আসলেই খারাপ লাগছে। শহর থেকে এসেছেন–লেখক মানুষ। ব্যঙের ডাক, ঝিঝির ডাক এইসব শুনতে চান।
স্যার, একটা হারিকেন কি বাইরে দিয়ে যাব? অন্ধকারে বসে আছেন।
অসুবিধা নেই অন্ধকার দেখতেই বসেছি। আলো নিয়ে এলে তো আর অন্ধকার যাবে না। তাই না?
অবশ্যই স্যার। অবশ্যই। আলো থাকলে–অন্ধকার কি করে দেখা যাবে?
পুষ্প বলল, বাবা এখন কি উনাকে খাবার দিয়ে আসবে? এগারোটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। খাবার গরম করব?
মোফাজ্জল করিম বিছানায় শুয়ে ছিলেন। সারাদিনের ক্লান্তিতে তাঁর তার মত এসে গিয়েছে। মেয়ের কথায় উঠে বসলেন।
খাবার গরম করব বাবা?
করে ফেল।
তোমার কি শরীর খারাপ করেছে?
না।
মন খারাপ না-কি বাবা?
করিম সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, মন খারাপ হবে কেন?
ঐযে ভদ্ৰলোক আমাদের সঙ্গে খেতে এলেন না। তুমি এত আগ্রহ করে সবাইকে দাওয়াত টাওয়াত করলে।
লেখক মানুষ, তাঁদের মন টন অন্য রকম।
লেখক হলেই বুঝি অভদ্র হতে হবে?
এই ধরনের মানুষরা ভদ্রতার ধার ধারেন না। তাদের যা ইচ্ছা করেন। কে কি ভাবল এইসব নিয়ে মাথা ঘামান না। এইসব নিয়ে মাথা ঘামাই আমরা–সাধারণ মানুষরা।
পুষ্প কেরোসিনের চুলায় খাবার গরম করছে। করিম সাহেব মেয়ের পাশে এসে বসেছেন। মেয়েটা অনেক কষ্ট করেছে। সারাদিন একা একা রান্না বান্না করেছে। গায়ে জ্বর ছিল, জ্বর নিয়েই করতে হয়েছে। অন্য সময় মতির মা সাহায্য করে। গত তিন দিন ধরে মতির মাও আসছে না।
পুষ্প তোর গায়ে কি জ্বর আছে?
না।
দেখি হাতটা দেখি।
পুষ্প হাত বাড়িয়ে দিল। করিম সাহেব লক্ষ্য করলেন–হাত তপ্ত।
না বললি কেন? জ্বর আছে তো।
আগুনের কাছে বসে আছি এই জন্যেই গা গরম। বাবা ভদ্রলোক কি খুব রাগী?
আরে দূর। রাগী হবে কেন? কথা কম বলেন। কেউ কথা বেশী বললেও বিরক্ত হন।
তাহলেতো তোমার উপর খুব বিরক্ত হয়েছেন। তুমি যা কথা বল।
আমি বেশী কথা বলি?
হুঁ। বল। মন ভাল থাকলে অনর্গল কথা বল। এতক্ষণ কথা না বলে চুপচাপ শুয়ে ছিলে তাই ভাবলাম তোমার মন বোধ হয় খারাপ।
আমার মন মোটেই খারাপ না। খুবই ভাল। এতবড় একজন মানুষ আমাদের সঙ্গে আছেন–ভাবতেই কেমন লাগে। গত সপ্তাহে ক্লাস সিক্সের রেপিড রীরে উনার যে গল্পটা আছে সেটা ছাত্রদের বুঝিয়ে দিলাম।
কোন গল্পটা?
মতিনের সংসার।
গল্পটা বেশী ভাল না।
কি বলিস তুই ভাল না। অসাধারণ গল্প।
আমার কাছে অসাধারণ মনে হয় নি। বাবা, সব কিছু গরম হয়ে গেছে। তুমি ইউনুসকে বল, উপরে নিয়ে যাক।
ইউনুস নিয়ে যাবে কি? আমি নিয়ে যাব। এতবড় একজন মানুষের খাবার আমি স্কুলের দপ্তরীকে দিয়ে পাঠাব? কি ভাবিস তুই আমাকে?
পুষ্প ক্ষীণ স্বরে বলল, বাবা আমি কি তোমার সঙ্গে আসব?
আয়। আসবি না কেন? পরিচয় করিয়ে দিব।
উনি আবার রাগ করবেন না তো?
রাগ করবেন কেন? রাগ ঘৃণা এইসব হচ্ছে আমাদের সাধারণ মানুষের ব্যাপার। উনারাতো সাধারণ মানুষ না। এই যে সন্ধ্যাবেলায় এসে বারান্দায় বসেছেন–এখনো গিয়ে দেখবি সেই একইভাবে বসে আছেন।