শওকত সাহেব ধরেই নিয়েছেন বর্ষা মন্দির, বাগান-বিলাসের মতই হবে। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তিনিও মহাকবির মত বলতে বাধ্য হবেন–Something is definitely wrong. তবে সোহাগী নামের নদী তাকে খানিকটা আকর্ষণ করল।
শুধু নামটির কারণে এই নদী একবার দেখে আসা যায়।
মহাকবি বললেন, আপনি গরীবের কথাটা রাখুন। কয়েকটা দিন ঐ বাড়িতে থেকে আসুন। স্বৰ্গসের অভিজ্ঞতা হবে। আপনার লেখা অন্য একটা ডাইমেনশন পেয়ে যাবে। বাড়ি সম্পর্কে যা বলেছি তার ষোল আনা যদি না পান। নিজের হাতে আমার কান দুটা কেটে নেড়ি কুত্তা দিয়ে খাইয়ে দেবেন। আমি কিছুই বলব না।
যদি যাই খাওয়া-দাওয়া কোথায় করব? বাবুর্চি সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে?
কিছুই নিয়ে যেতে হবে না। ময়নালা স্কুলের এ্যাসিসটেন্ট হেডমাস্টার সাহেবকে আমি একটা চিঠি দিয়ে দেব। খুবই মাই ডিয়ার লোক। যা করার সেই করবে। এবং যে কদিন থাকবেন আপনাকে মাথায় করে রাখবে।
তিনি ময়নাতলায় মহাকবির ব্যবস্থা মতই এসেছেন।
মহাকবি তাঁকে ট্রেনে তুলে দিতেও এসেছিলেন। ময়নাতলা জায়গাটিার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা বলতে গিয়ে আরেকবার উচ্ছসিত হলেন। তবে ট্রেন ছাড়িবার আগ মুহূর্তে লজ্জিত গলায় বললেন, ভাই আপনাকে একটা রং ইনফরমেশন দিয়েছি। নদীটার নাম সোহাগী না। আসলে নদটিার কোন নাম নেই। সবাই বলে ছোট গাঙ। সোহাগী নামটা আমার দেয়া।
শওকত সাহেব হেসে ফেলে বললেন, কদমের বনও নিশ্চয়ই নেই? আপনার কল্পনা।
মহাকবি উত্তেজিত গলায় বললেন, আছে। অবশ্যই আছে। নদীর নাম ছাড়া বাকি সব যেমন বলেছি তেমন। যদি এক বিন্দু মিথ্যা হয়, আমার কান দুটা কেটে কুত্তা দিয়ে খাইয়ে দেবেন। আমি বাকি জীবন ভ্যানগের মত কান মাফলার দিয়ে বেঁধে ঘুরে বেড়াব। অনেস্ট। নদীর নামের ব্যাপারে আপনার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলেছি–ক্ষমা প্রার্থনা করছি। নামতো বড় না, জিনিসটাই বড়। অসাধারণ নদী, একবার সামনে দাঁড়ালে পাগল হয়ে যেতে ইচ্ছা করে।
বাড়ির সামনে শওকত সাহেব বিমর্ষ মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। পাগল হয়ে যাবার মত কিছুই দেখছেন না। অতি পুরাতন জরাজীর্ণ দোতলা ভবন। ছাদ ধ্বসে গেছে কিংবা ভেঙ্গে পড়েছে বলে পরবর্তি সময়ে টিন দেয়া হয়েছে। টানা বারান্দা। ঠিকই আছে–তবে রেলিং জায়গায় জায়গায় ভেঙ্গে পড়েছে। বারান্দায়। হাঁটাহাঁটি করা বিপদজনক হতে পারে। বর্ষাকাল, বৃষ্টির পানিতে বারান্দা পিচ্ছিল হয়ে আছে।
শওকত সাহেব বললেন, এটাই কি বর্ষা-মন্দির?
করিম সাহেব অবাক হয়ে বললেন, আপনার কথা কিছু বুঝলাম না স্যার। বর্ষামন্দির বলছেন কেন?
বাড়িটা কি গৌরীপুরের মহারাজার?
জি না। আমার দাদাজান সেই আমলে লাখপতি হয়ে বাড়ি বানিয়েছিলেন, তারপর অপঘাতে মারা গেলেন। অবস্থা পড়ে গেল। এই বাড়িটা ছাড়া–এখন। আমাদের আর কিছুই নাই। বাড়িটাও হয়েছে বাসের অযোগ্য। আমি নীচের তিনটা ঘরে থাকি। উপরটা তালাবন্ধ থাকে। আপনার জন্যে উপরের একটা ঘর ঠিক ঠাক করে রেখেছি।
বাড়ির চারদিকে কি এক সময় কদম গাছ ছিল?
জি না। একটা কদম গাছ বাড়ির সামনে ছিল। তিন বছর আগে গাছের উপর বজ্ৰপাত হল। চলুন স্যার আপনার ঘরটা দেখিয়ে দেই।
চলুন।
সিডিতে সাবধানে পা ফেলবেন। মাঝে মধ্যে ভাঙ্গা আছে।
বাথরুম আছে তো।
জি আছে। বাথরুম আছে, আপনার ঘরের সাথেই আছে।
খাবার পানি কোত্থেকে আনেন? নদীর পানি?
জি না। টিউব ওয়েল আছে। বজলুর রহমান সাহেব চিঠিতে জানিয়েছেন–আপনাকে পানি ফুটিয়ে দিতে। পানি ফুটিয়ে বোতলে ভরে রেখেছি।
ভাল করেছেন।
স্যার আপনি কি গোসল করবেন? গোসলের পানি গরম করে দেব?
পানি গরম করতে হবে না। ঠাণ্ডা পানিতেই গোসল করব।
খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা স্যার আমার এখানে করেছি। দরিদ্র অবস্থায় যা পারি–সামান্য আয়োজন।
মোফাজ্জল করিম সাহেব, কিছু মনে করবেন না। আপনাকে একটা কথা বলি, আপনি একজন বাবুর্চির ব্যবস্থা করুন। যে আমার জন্যে রান্না করবে। আমি টাকা দিয়ে দেব।
তা কি করে হয়?
তাই হতে হবে। আমি তো বজলুর রহমান সাহেবকে বলেছিলাম আপনাকে এই ভাবে চিঠি দিতে। চিঠি দেন নি ….
জি না, এইসব কিছু তো লিখেন নাই।
উনি আমাকে বলেছেন, বাবুর্চির ব্যবস্থা হয়েছে, আমি তাই মনে করে এসেছি। নয়ত আসতাম না।
আপনি একজন অতি বিশিষ্ট ব্যক্তি। আপনার সামান্য সেবা করার সুযোগ পাওয়াতো স্যার ভাগ্যের কথা…
ভাই আপনাকে যা করতে বলছি করুন।
রাতে মোফাজ্জল করিম সাহেব, শওকত সাহেবকে খাবার জন্যে ডাকতে এলেন। নীচু গলায় বললেন, বাবুর্চির ব্যবস্থা স্যার কাল পরশুর মধ্যে করে ফেলব। অজ পাড়া গাঁ জায়গা। বাবুর্চিতো পাওয়া যাবে না। একটা মেয়েটেয়ে জোগাড় করতে হবে। আজ গরীবখানায় সামান্য আয়োজন করেছি।
শওকত সাহেব বললেন, আপনি একটা কাজ করুন, খাবারটা এখানে পাঠিয়ে দিন।
কিছু বিশিষ্ট লোককে দাওয়াত করেছিলাম স্যার। হেড মাস্টার সাহেব, ময়নাতলা থানার ওসি সাহেবও এসেছেন। ময়নাতলা থানার ওসি সাহেব বিশিষ্ট ভদ্রলোক। সাহিত্য অনুরাগী।
আমি এখন আর নীচে নামব না। আপনি কিছু মনে করবেন না।
স্যার উনারা আগ্রহ নিয়ে এসেছিলেন।
অন্য কোন এক সময় তাঁদের সঙ্গে কথা বলব।
মোফাজ্জল করিম সাহেব খুবই অপ্রস্তুত মুখ করে নীচে নেমে গেলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই উঠে এলেন। শওকত সাহেব বললেন, কি ব্যাপার?
স্যার আপনার বোতলটা এসে পৌঁছেছে। এই যে স্যার বোতল।