আসার সময় তোমার মুখ কালো বলে মনে হল। তাড়াহুড়ায় জিজ্ঞেস করা হয় নি। তাছাড়া ভাবলাম বিদায় মুহূর্তে কোন কারণে আমার উপর রাগ করে থাকলেও তা প্রকাশ করবে না। ইদানীং কথা চেপে রাখার এক ধরনের প্রবণতা তোমার মধ্যে লক্ষ্য করছি। একবার অবশ্যি আমাকে বলেছিলে তোমাকে কিছু বলা আর গাছকে কিছু বলা প্রায় একরকম। গাছকে কিছু বললে গছি শুনতে না পেলেও গাছের ডালে বসে থাকা পাখিরা শুনতে পায়। তোমাকে বললে কেউ শুনতে পায় না। এই কথাগুলি তুমি ঠাট্টা করে বলেছ না মনের বিশ্বাস থেকে বলেছ আমি জানি না। মন থেকে বললেও আমার প্রতিবাদ করার কিছু নেই। আমি নিজেও বুঝতে পারছি আজকাল তোমার কথা মন দিয়ে শুনছি না। আমাকে বলার মত কথাও কি তোমার খুব বেশী আছে? সংসার, ছেলেমেয়ে। নিয়ে তুমি ব্যস্ত হয়ে পড়েছ। রাত দশটা পর্যন্ত বাচ্চাদের পড়িয়ে, খাইয়েদাইয়ে, ঘুম পাড়িয়ে তুমি যখন ক্লান্ত পরিশ্রান্ত তখন আমি বসছি লেখা নিয়ে। সময় কোথায়? খুব সূক্ষ্ম হলেও সংসার নামক সমুদ্রে দুটি দ্বীপ তৈরী হয়েছে। একটিতে আমি, অন্যটিতে ছেলেমেয়ে নিয়ে তুমি। তাই নয় কি?
স্বেচ্ছা নির্বাসনে কিছুদিন কটিাতে এসেছি। পরিকল্পনা মত লেখালেখি করব, তার ফাঁকে অবসরের সময়টা আমাদের জীবন নিয়ে চিন্তা ভাবনাও করব। জীবনের একঘেঁয়েমীতে আমি খানিকটা ক্লান্ত। নতুন পরিবেশ সেই ক্লান্তি দূর করবে না আরো বাড়িয়ে দেবে কে জানে!
ভাল লাগবে বলে মনে হচ্ছে না। সারাজীবন শহরে থেকেছি। শহরের সুবিধা ও অসুবিধায় এত অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়ানো কষ্টকর হবে বলে মনে হয়। কষ্ট করার একটা বয়স আছে। সেই বয়স পার হয়ে এসেছি। তাছাড়া এখনি হোমসিক বোধ করছি। আসার সময় স্বাতীর জ্বর দেখে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম ঘর থেকে বেরুবার আগে তার কপালে চুমু খেয়ে আসব। ড্রাইভার নীচে এত ঘন ঘন হর্ণ বাজাতে লাগল যে সব ভুলে নীচে নেমে এলাম। বেচারীর জরতপ্ত কপালে চুমু খাওয়া হল না। আমার হয়ে ওকে আদর করে দিও।
আশার থাকার জায়গা কি করা হয়েছে এখনো জানি না। মোফাজ্জল করিম সাহেবকেও কিছু জিজ্ঞেস করি নি। জিজ্ঞেস করলেই তিনি লং প্লেইং রেকর্ড চালু করবেন। তা শুনতে ইচ্ছা করছে না।
আস্তানায় পৌঁছেই আস্তানা সম্পর্কে তোমাকে জানাব। জায়গাটা পছন্দ হলে তোমাকে লিখব। সবাইকে নিয়ে চলে আসবে। তবে জায়গা পছন্দ হবে বলে মনে হচ্ছে না।
অনেক অনেক দিন পর তোমাকে দীর্ঘ চিঠি লিখলাম।
ভাল থাক এবং সুখে থাক।
থাকার জায়গা আহামরি ধরনের হবে
থাকার জায়গা আহামরি ধরনের হবে এ জাতীয় ধারণা শওকত সাহেবের ছিল না। অজ পাড়াগাঁয়ে রাজপ্রাসাদ থাকার কোনই কারণ নেই। তবে বজলুর রহমান যিনি এই জায়গার খোঁজ তাঁকে দিয়েছেন, তিনি বার তিনেক উজ্জ্বলিত গলায় বলেছেন, আপনি মুগ্ধ হয়ে যাবেন। এত সুন্দর বাড়ি যে কল্পনাও করতে পারবেন না। শওকত সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, তাজমহল ধরনের বাড়ি?
তাজমহলতো বাড়ি না। তাজমহল হচ্ছে কবরখানা। মমতাজ মহলের কবর। আপনাকে যে বাড়িতে পাঠাচ্ছি সেটা গৌরীপুর মহারাজার বর্ষা-মন্দির।
বর্ষা-মন্দির মানে?
শীতের সময় কাটানোর জন্যে মহারাজার একটা বাড়ি ছিল। সেটার নাম শীত-মন্দির। তেমনি বর্ষাকাল কাটানোর জন্যে একটা বাড়ি তার নাম বর্ষা মন্দির। দোতলা বাড়ি। বৃষ্টির শব্দ যাতে শোনা যায় সে জন্যে বাড়ির ছাদ টিনের। বৃষ্টি দেখার জন্যে বিরাট টানা বারান্দা। উত্তরেও বারান্দা, দক্ষিণেও বারান্দা। উত্তরের বারান্দায় দাঁড়ালে গারো পাহাড় দেখা যায়। দক্ষিণের বারান্দায় দাঁড়ালে দেখবেন–সোহাগী নদী।
কি নদী?
সোহাগী নদী। বর্ষাকালে যাবেন, নদী থাকবে কানায় কানায় ভরা। বৃষ্টির ফোটা নদীতে পড়লে কী যে সুন্দর দেখা যায় তা ঐ বাড়ির বারান্দায় না দাঁড়ালে বুঝবেন না। বাড়িটার চারদিকে কদমের গাছ। বর্ষাকালে কদম ফুলে গাছ ছেয়ে যায়–সে এক দেখার মত দৃশ্য। বাংলাদেশের কোথাও একসঙ্গে এতগুলি কদমের গাছ দেখবেন না।
শওকত সাহেব খুব একটা উৎসাহ বোধ করলেন না। বজুলুর রহমানের কোন কথায় উৎসাহী হয়ে ওঠা ঠিক না। ভদ্ৰলোক মাথা খারাপ ধরনের। নিজেকে মহাকবি হিসেবে পরিচয় দেন। শোনা যায় সতের বছর বয়সে বঙ্গ বন্দনা নামে মহাকাব্য লেখা শুরু করেছিলেন। শেষ করেছেন চল্লিশ বছর বয়সে। এখন কারেকশান চলছে। দশ বছর হয়ে গেল, কারেকশান শেষ হয় নি।
মহাকবি বজলুর রহমান–অদ্ভুত, অসাধারণ, পাগল হয়ে যাবার মত বিশেষণ ছাড়া কথা বলতে পারেন না।
একবার গুলশানের এক বাড়িতে বাগান বিলাস গাছ দেখে খুব উত্তেজিত হয়ে ফিরলেন। চোখ বড় বড় করে বললেন, এই জিনিস না দেখলে জীবন বৃথা। ইন্দ্রপূরীর বাগান-বিলাসও এর সামনে দাঁড়াতে পারবে না। লাল রঙের যে কটা শেড আছে তার প্রতিটি ঐ গাছের পাতায় আছে। বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। তাকিয়ে থাকলে বুকে ব্যথা করে। এ্যবসুলিউট বিউটি সহ্য করা মানুষের পক্ষে খুবই কঠিন। বুঝলেন ভাই সাহেব গাছটার সামনে দাঁড়িয়ে মনে হল, পাগল হয়ে যাব।
পাগলতো আছেনই। নতুন করে কি আর হবেন?
ঠাট্টা না ভাই। সতি বলছি। একদিন আমার সঙ্গে চলুন। আপনার দেখা উচিত।
শওকত সাহেব মহাকবিকে সঙ্গে নিয়ে একদিন গেলেন। বাড়ির সামনে দাড়িয়ে বললেন, আপনি কি নিশ্চিত এই সেই বিখ্যাত ইন্দ্ৰপুরীর গাছ? মহাকবি মাথা চুলকে বললেন, জ্বি এইটাই সেই বাগান-বিলাস। তবে আজ অবশ্যি সেদিনের মত লাগছে না। ব্যাপারটা কি বুঝতে পারছি না। Something is definitely wrong.