শওকত সাহেব জবাব দিলেন না। কথা বললেই কথার পিঠে কথা বলতে হবে। ইচ্ছা করছে না। এক ধরনের ক্লান্তিও বোধ করছেন। বিছানায় শুয়ে পড়লে হয়। কোলবালিশ দেখার পর থেকে কোলবালিশ জড়িয়ে শুয়ে পড়তে হচ্ছে করছে।
স্যার, তরকারীতে কেমন ঝাল খান তাতো জানি না। আমি বলেছি ঝাল কম। দিতে। খুব বেশী কম হলে কাচা মরিচ আছে। আমার নিজের গাছের কাচা মরিচ
অসম্ভব কাল। সাবধানে কামড় দিবেন।
শওকত সাহেব কিছুই বললেন না। এক জায়গায় বসে একদিকে তাকিয়ে আছেন। চোখের সামনের দৃশ্য এখন খানিকটা একঘেঁয়ে হয়ে গেছে। নৌকার চুলা থেকে ভেজা কাঠের কারণে প্রচুর ধোয়া আসছে। চোখ জ্বলা করছে। ধোয়া। অন্যদিকে সরানোর জন্যে করিম সাহেব তালপাতার একটা পাখা দিয়ে ক্ৰমাগত হাওয়া করে যাচ্ছেন। এতে কোন লাভ হচ্ছে না। বরং ধোয়া আরো বেশী হচ্ছে।
করিম সাহেব।
জ্বি স্যার।
আমি, আপনাকে একটা কথা বলতে চাচ্ছি। যদি কিছু মনে না করেন।
অবশ্যই বলবেন স্যার। অবশ্যই।
আমি মানুষজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে তেমন আগ্রহ বোধ করি না। ভাল লাগে না। চুপচাপ থাকতে পছন্দ করি।
সেটা আপনাকে বলতে হবে না। আপনাকে দেখেই বুঝেছি। স্টেশন মাস্টার সাহেবকে এই কথাই বলছিলাম।
করিম সাহেব, আমি আমার কথাটা শেষ করতে পারি নি–আপনাদের ওখানে আমি যাচ্ছি খুব নিরিবিলিতে কিছু কাজ করতে। শহরের পরিবেশে মন হাঁপিয়ে গেছে। নতুন পরিবেশের কোন ছাপ লেখায় পড়ে কি-না সেটা দেখতে চাচ্ছি। কাজেই আমি যা চাই তা হচ্ছে–নিরিবিলি।
স্যার আপনাকে কেউ বিরক্ত করবে না। গ্রামের লোকজন যদি আসেও সন্ধ্যার পর আসবে। এরা আপনার কাছ থেকে দুএকটা মূল্যবান কথা শুনতে চায়।
আমি কোন মূল্যবান কথা জানি না।
এটাতো স্যার, আপনি বিনয় করে বলছেন।
না বিনয় করে বলছি না। বিনয় ব্যাপারটা আমার মধ্যে নেই।
খাবার সময়ও খুব যন্ত্রণা হল। করিম সাহেব প্লেটে ভাত তুলে দিচ্ছেন, তরকারী তুলে দিচ্ছেন। শওকত সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, প্লীজ কিছু তুলে। দেবেন না। যা দরকার আমি নিজে নেব। কেউ খাবার তুলে দিলে আমার খুব অস্বস্তি লাগে।
আপনিতো স্যার কিছুই নিচ্ছেন না, মুরগীর বুকের গোশত একটু দিয়ে দেই।
তিনি শুধু যে মুরগীর বুকের গোশত দিলেন তাই না। এক টুকরা লেবু নিজেই শওকত সাহেবের প্লেটে চিপে দিলেন।
কাগজি লেবুটা স্বাস্থের জন্যে ভাল। আমার গাছের কাগজি স্যার।
ভাল।
ছটা কাগজি লেবুর গাছ আছে–এর মধ্যে দুটা গাছ বাঁজা। ফুল ফোটে–ফল হয় না।
গাছগুলো কাটায়ে ফেলব ভেবেছিলাম–আমার মেয়ে দেয় না। ও কি বলে জানেন স্যার? ও বলে বাজা গাছ বলেই কেটে ফেলবে? কত বাজা মেয়েমানুষ আছে। আমরা কি তাদের কেটে ফেলি? আমি ভেবেছিলাম কথা খুবই সত্য। আমার নিজের এক ফুপু ছিলেন, বাজা। কলমাকান্দায় বিয়ে হয়েছিল। খুব বড় ফ্যামেলি। তারা অনেক চেষ্টাচরিত করেছে। ডাক্তার কবিরাজ কিছুই বাদ দেয় নাই। তারপর নিয়ে গেল আজমীর শরীফ। সেখান থেকে লাল সূতা বেঁধে নিয়ে। আসল। খোদার কি কুদরত–আজমীর শরীফ থেকে ফেরার পর একটা সন্তান হল। আমি চিন্তা করে দেখলাম–আমার লেবু গাছের বেলায়ওতো এটা হতে পারে।
শওকত সাহেব হাত ধুতে ধুতে বললেন, নিশ্চয়ই হতে পারে। আপনি একটা টবে গাছ দুটাকে আমীর শরীকে নিয়ে যান। লাল সূতা বেঁধে আনুন।
করিম সাহেব কিছু বললেন না, তাকিয়ে রইলেন। সম্ভবত রসিকতাটা তিনি ধরতে পারেন নি।
করিম সাহেব।
জ্বি স্যার।
আপনাদের ওখানে পোস্ট অফিস আছে তো?
জি আছে। আমাদের গ্রামে নাই। শিবপুরে আছে। আমরা পোস্টাপিসের জন্যে কয়েকবার দরখাস্ত দিয়েছি। পোস্ট মাস্টার জেনারেলের এক শালার বিবাহ হয়েছে আমাদের গ্রামে, মুনশি বাড়িতে। উনার মারফতে গত বৎসর একটা দরখাস্ত দিয়েছি। উনি আশা দিয়েছেন–হয়ে যাবে।
শিবপুর আপনাদের গ্রাম থেকে কতদূর?
বেশী না, চার থেকে সাড়ে চার মাইল।
আমি আমার স্ত্রীর কাছে একটা চিঠি পাঠাতে চাই–পৌঁছানোর সংবাদ।
কোন চিন্তা নাই স্যার। চিঠি এবং টেলিগ্রাম দুটারই ব্যবস্থা করে দেব।
শওকত সাহেব সুটকেস খুলে চিঠি লেখার কাগজ বের করলেন। বৃষ্টি আবার জোরে সোরে এসেছে। এক হাত দূরের জিনিস দেখা যায় না এমন বৃষ্টি। এর মধ্যেই নৌকা ছাড়া হয়েছে। নৌকার মোট তিনজন মাঝি। একজন হাল ধরে বসে আছে। দুজন দাঁড় টানছে। বৃষ্টির পানিতে ভেজার জন্যে তাদের মধ্যে কোন বিকার নেই। যে দুজন দাঁড় টানছে তাদের দেখে মনে হচ্ছে–দাঁড় টানার কাজে খুব আরাম পাচ্ছে। করিম সাহেব ছাতা মাথায় দিয়ে বাইরে বসে আছেন। শওকত সাহেবের অসুবিধা হবে এই কারণে তিনি ছই এর ভেতর যেতে রাজি হন নি। শওকত সাহেব সুটকেসের উপর কাগজ রেখে পেন্সিলে দ্রুত লিখে যাচ্ছেন। তার লেখা কাচা তবে গোটা গোটা–দেখতে ভাল লাগে।
কল্যাণীয়া,
হাতের লেখা কি চিনতে পারছ?
নৌকায় বসে লেখা কাজেই অক্ষরগুলি এমন চ্যাপ্টা দেখাচ্ছে। ঠাকরোকোনা স্টেশনে ঠিকমতই পৌঁছেছি। মোফাজ্জল করিম সাহেব উপস্থিত ছিলেন। নাম শুনে মনে হয়েছিল ভদ্রলোকের দাড়ি থাকবে। মাথায় টুপী থাকবে এবং মাপে লম্বা, ন্যাপলিনের গন্ধমাখা কোট থাকবে গায়ে। কোটের অংশ শুধু মিলেছে। ভদ্রলোক সারাক্ষণ কথা বলেন। অনায়াসে তাঁকে কথাসাগর উপাধি দেয়া যায়। কথা বলা লোকজন কাজকর্মে কাঁচা হয়। ভদ্রলোক তা না। তাঁকে সর্বকর্মে অতি উৎসাহী মনে হল। তার অতিরিক্ত রকমের উৎসাহে ঘাবড়ে যাচ্ছি। ভাত খাওয়ার সময় ভদ্রলোক নিজে লেবু চিপে আমার পাতে ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন। অবস্থাটা ভাবো।